৮০ বছরে নাগাসাকি শহর অনেক বদলে গেছে, স্থানে স্থানে আধুনিকায়নের ছোঁয়া লেগেছে। কিন্তু জাপানের এই শহরের অসংখ্য মানুষের মন পড়ে আছে ৮ দশক আগের বিভৎস এক ঘটনায়।
আগামী ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে মার্কিন পারমাণবিক হামলার ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। কিছু মানুষ আজও যুদ্ধের সেই ভয়াল স্মৃতি ধরে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের একজন ৮৩ বছর বয়সী ফুমি তাকেশিতা।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট। সকালটা ছিল অন্যান্য দিনের মতোই। কিন্তু সেই দিনেই শহরের ওপর নেমে আসে মৃত্যুর ছায়া। মার্কিন বাহিনীর ফেলা পারমাণবিক বোমা মুহূর্তেই ধ্বংস করে দেয় হাজারো প্রাণ, ভবন এবং নাগাসাকির চিরচেনা চিত্র।
শহরের কেন্দ্রস্থল উরাকামি এলাকায় মাত্র ৫০০ মিটার দূরে ছিল শিরোইয়ামা প্রাথমিক বিদ্যালয়। ধারণা করা হয়, সেখানে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যান, যাদের মধ্যে ছিলেন বহু শিশু ও শিক্ষক।
শুধু ভবন বা জীবন নয়, ধ্বংস হয় মানুষের স্বপ্ন, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস। আজ ৮০ বছর পর, কিছু ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে—ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি ভবনের অংশ এখন পরিচিত পিস মেমোরিয়াল হল নামে। প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সেখানে আসেন ইতিহাসের সাক্ষী হতে।
তবে শহরের বেশিরভাগ ভৌত ধ্বংসাবশেষই কালের গর্ভে বিলীন। তাই ফুমি তাকেশিতার মতো কিছু মানুষ চেষ্টা করছেন এসব স্মৃতিচিহ্ন রক্ষা করতে। শিশু অবস্থায় বোমা বিস্ফোরণের অভিজ্ঞতা পাওয়া ফুমি বলেন, ‘আমি জানালা দিয়ে তীব্র আলো আসতে দেখেছি… এত তীব্র যে চোখ খোলা রাখা যাচ্ছিল না।’
তিনি খালি হাতে মাটি খুঁড়ে হিবাকুর ধ্বংসাবশেষ (বোমার প্রভাবপূর্ণ অবশিষ্ট বস্তু) সংগ্রহ করেছেন। তাঁর বিশ্বাস, এই বস্তুগুলিই প্রমাণ বহন করে যে কীভাবে মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছিল।
ফুমি বলেন, ‘শুধু মানুষদের কণ্ঠসাক্ষ্য নয়, এই বস্তুগুলিও বলছে কী ঘটেছিল—গলে যাওয়া ধাতব কাঠামো, ধ্বংসপ্রাপ্ত দরজা, পোড়া গাছ…।’
তবে শহরের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান প্রজন্মের প্রয়োজন ও শহর উন্নয়নের বাস্তবতা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
নাগাসাকি শহরের অ্যা-বোমা উত্তরাধিকার বিভাগের প্রধান ইউসুকে তানাকা বলেন, ‘সংরক্ষণ ও আধুনিকায়নের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে আমাদের নির্দিষ্ট সীমা টানতে হয়।’
বর্তমানে শহর কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর অনুমোদিত হিবাকু ধ্বংসাবশেষের একটি তালিকা প্রকাশ করে। সর্বশেষ তালিকায় সেতু, গাছ, গির্জা ইত্যাদি মিলিয়ে ৫৫টি উপাদান রয়েছে।
তবু ফুমি ও তাঁর মতো কর্মীরা মনে করেন, আরও সংরক্ষণের দরকার ছিল।
‘উরাকামি ক্যাথেড্রাল যদি ভেঙে না ফেলা হতো, তাহলে এটি হিরোশিমার গম্বুজের মতো আন্তর্জাতিক প্রতীক হতে পারত’, বলেন তিনি।
স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগলেও ফুমি প্রতি মাসে নাগাসাকি পিস মেমোরিয়াল পার্কে অবস্থান বিক্ষোভে অংশ নেন। এবার ৯ আগস্ট তিনি হাইপোসেন্টারের কাছে শান্তি সমাবেশে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন।
তাঁর বার্তা পরিষ্কার—‘আমার সময় খুব বেশি নেই, কিন্তু ইতিহাস রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের।’
নাগাসাকির ধ্বংসাবশেষ কেবল পাথর বা কাঠের গাঁথুনি নয়, তা এক এক টুকরো ইতিহাস। এই ইতিহাস মানুষকে যুদ্ধের ভয়াবহতা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং ভবিষ্যতের জন্য শান্তির বার্তা বহন করে। ফুমি তাকেশিতার সংগ্রাম সেই বার্তারই একটি জীবন্ত উদাহরণ।