ইন্দোনেশিয়ায় সরকার পতনের আন্দোলন কেন?

শ্রীলংকা, বাংলাদেশের পর এবার সরকারের পতনের আন্দোলনে উত্তাল ইন্দোনেশিয়া। মানুষ রাস্তায় নেমে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। সংঘর্ষ দেশটির ভবিষ্যতকেও অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হওয়ার কোন ইঙ্গিত মিলছে না। মূলত সরকারের বেশকিছু সিদ্ধান্ত সম্প্রতি সাধারণ মানুষকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল, যার প্রভাবে আন্দোলন ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী রুপ নেয়।

সহিংস আন্দোলন থামাতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও ব্যাপক বল প্রয়োগ করেছে, যা আন্দোলনকারীদের আরও উত্তেজিত করেছে।

ইন্দোনেশিয়ায় সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণ
ইন্দোনেশিয়ায় অভিজাতদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের বৈষম্য ব্যাপক। তার সরকারের কয়েকটি পদক্ষেপকে তাদের স্বার্থবিরোধী হিসেবে দেখছে।

সংসদ ভাতায় বিস্ফোরণের শুরু

ইন্দোনেশিয়ায় গত আগস্টের শেষ দিকে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, তা এখন পূর্ণমাত্রার সরকারবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নিয়েছে।

এর মূল কারণ ছিল সংসদ সদস্যদের জন্য মাসিক ৫০ মিলিয়ন রুপিয়া (প্রায় ৩ হাজার মার্কিন ডলার) হাউজিং ভাতা অনুমোদন। এই অঙ্কটি ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরির তুলনায় ১০-২০ গুণ বেশি।

অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশের সাধারণ মানুষ মনে করছে, তাদের কষ্টের কোনো মূল্য নেই, অথচ রাজনীতিবিদরা বিলাসিতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ফলে জনগণের ক্ষোভ আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী জাকার্তা থেকে শুরু করে জাভা, সুমাত্রা, সুলাওসি ও কালিমান্তান দ্বীপে।

বিক্ষোভের মুখে সংসদ অবশেষে হাউজিং ভাতা বাতিল করতে বাধ্য হয়। একই সঙ্গে সংসদ সদস্যদের বেতন বৃদ্ধি ও অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যদিও এই সিদ্ধান্ত জনগণের দাবির সামনে একটি ছোট সাফল্য, তবে বিশ্লেষকদের মতে এটি মূল সংকটের সমাধান নয়।

ডেলিভারি ড্রাইভারের মৃত্যুতে ক্ষোভ চরমে

২১ বছর বয়সী খাবার সরবরাহকারী তরুণ আফফান কুরনিয়াওয়ান বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের গাড়ির চাপায় নিহত হন। তিনি নিজে আন্দোলনে অংশ নেননি, বরং খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য মোটরবাইকে যাচ্ছিলেন।

এই মৃত্যুর পর জনগণের মধ্যে ক্ষোভ নতুন মাত্রা পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাখো মানুষ ন্যায়বিচারের দাবি তোলে। সাধারণ মানুষের কাছে এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অবহেলার প্রতীক। কারণ ইন্দোনেশিয়ার কোটি তরুণ খাবার ডেলিভারি বা গিগ-ইকোনমির কাজে জড়িয়ে আছেন- যেখানে আয় অল্প, সুযোগ-সুবিধা নেই, অথচ ঝুঁকি অনেক।

ইমরান হোসেন নামের এক ডেলিভারি কর্মীর ভাষ্য,, “অসাম্যই এই আন্দোলনের মূল কারণ। ধনী-গরিবের ফারাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বৈষম্য-এসবের প্রতিফলনই আমরা রাস্তায় দেখছি। সংসদ সদস্যরা লাখ লাখ টাকা ভাতা নিচ্ছেন, অথচ সাধারণ মানুষ খাবারের জন্য হাহাকার করছে।”

রাষ্ট্রপতির প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা

২০২৪ সালের অক্টোবরে ক্ষমতায় আসা রাষ্ট্রপতি প্রাবোও সুবিয়ান্টো নির্বাচনের সময় ৫ বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার নীতিই এখন সমালোচনার কেন্দ্রে।

তিনি স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রি লাঞ্চ প্রোগ্রাম চালু করেছেন, যার বার্ষিক খরচ প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল ব্যয় মেটাতে সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামো খাতে ১৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় কমিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কাটছাঁট সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনে আঘাত করছে। ফলে জনগণের মনে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটিই এখন সড়কে বিস্ফোরিত হচ্ছে।

দেশটির একজন বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “প্রাবোও নিজেকে সংস্কারক হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তিনি অভিজাতদের স্বার্থ রক্ষা করছেন। যদি তিনি এখনই দুর্নীতি ও দমননীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নেন, তাহলে আন্দোলন থামানো তার পক্ষে কঠিন হবে।”

সামরিক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ

প্রাবোও সুবিয়ান্টো নিজে সাবেক সেনা কর্মকর্তা। ক্ষমতায় এসে তিনি নতুন নতুন সামরিক ব্যাটালিয়ন গঠন করছেন এবং আগামী ৫ বছরে শতাধিক নতুন ব্যাটালিয়ন গড়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন।

এই পদক্ষেপ আচেহ প্রদেশে নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে। স্থানীয়রা মনে করছেন, এটি আবারও সামরিক দমননীতির দিকে দেশকে ঠেলে দেবে।

একজন সমাজকর্মী বলেন, “আমরা ৩৫ বছর সামরিক সংঘাত সহ্য করেছি। হাজারো প্রাণ গেছে। এখন আবার নতুন ব্যাটালিয়ন মানে পুরনো ক্ষত আবারও উসকে দেওয়া।”

জীবনযাত্রার ব্যয় ও সাধারণ মানুষের কষ্ট

ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্টে মূল্যস্ফীতি আগের বছরের তুলনায় ২.৩১ শতাংশ বেড়েছে।

সরকার বলছে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরে আছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ বলছে এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই।

পূর্ব কালিমান্তানের গৃহিণী রহমাওয়াতি বলেন, “প্রতিবছর চাল-ডাল, তেল, চিনি- সবকিছুর দাম বাড়ছে। একবার বাড়লে আর কখনো কমে না। রাজনীতিবিদরা শুধু ভোটের সময় আমাদের মনে রাখেন, পরে ভুলে যান।”

নারীদের সরব উপস্থিতি

আন্দোলনে নারীরাও সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছেন, যা সরকারকে আরও চাপে ফেলেছে।

জাকার্তার নারী অধিকারকর্মী আফিফাহ মনে করেন, আন্দোলন শুধু সংসদ ভাতা নয়, বরং সামগ্রিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব, সামরিক বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি- এসব কারণেই জনগণ ক্ষুব্ধ। অথচ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমাতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ছুড়ছে। এটি মানুষের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন।

“আমরা চাই সংস্কার। শুধু অর্থনীতি নয়, গণতন্ত্র ও পরিবেশ- সবখানেই পরিবর্তন দরকার। এই পরিবর্তন হতে হবে সর্বজনীন, যেখানে নারীরাও সমান অংশীদার।”

সবমিলিয়ে ইন্দোনেশিয়া এক কঠিন সঙ্কটে দাঁড়িয়ে। সংসদের ভাতা বাতিল হলেও জনগণের মূল ক্ষোভ অর্থনৈতিক বৈষম্য, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতি ও সামরিক প্রভাবের বিরুদ্ধে। তারা সমতা ও স্বচ্ছতা চান, সরকারের কাছে জবাবদিহিতা চান।

যদি সরকার দ্রুত সঠিক পদক্ষেপ না নিতে পারে, তবে এই আন্দোলন ইন্দোনেশিয়ার রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করে দিতে পারে।