ব্যাংকক, পাতায়া, চিয়াং মাই, ফুকেট, ক্রাবি- এমন অসংখ্য আকর্ষণীয় স্থান নিয়ে থাইল্যান্ড বছরের পর বছর ধরে পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
প্রতি বছর কোটি কোটি পর্যটক শহুরে সংস্কৃতি, কৃষি পর্যটন, পাহাড় আর সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জল উপভোগ করতে দেশটি ভ্রমণ করতে যান।
সেই উৎসাহে যে এবার ভাটা পড়েছে, তা দেখা যাচ্ছে দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানে। ব্যাংককমুখী পর্যটক দিন দিন কমে যাচ্ছে, পরিসংখ্যান তাই বলছে।
তাতে থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদেরও আয় কমছে।
এর জন্য থাই সরকারের দুর্বল পর্যটন ব্যবস্থাপনাকে দায় দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
থাইল্যান্ডে পর্যটক কতটা কমছে?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এতদিন সবচেয়ে বেশি পর্যটক যেতেন থাইল্যান্ডে।
এ বছর সেই মুকুট হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকক। বিপরীতে মালয়েশিয়া ও চীনে পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে, এই অঞ্চলে এখন সবচেয়ে বেশি পর্যটক যাচ্ছে দেশ দুটিতে।
দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বছরের প্রথম ৬ মাসে থাইল্যান্ডে বিদেশী পর্যটক কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪.৫৬%।
এই সময়কালে প্রায় ১৬.৬১ মিলিয়ন বিদেশী পর্যটক থাইল্যান্ড গিয়েছে।
২০২৫ সালে দেশটিতে পৌঁণে ৪ কোটি পর্যটক আসার পূর্বাভাস দিয়েছিল ব্যাংক অফ থাইল্যান্ড। গেল সপ্তাহে তা কমিয়ে সাড়ে ৩ লাখ করা হয়েছে।
থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, পর্যটন খাতে মন্দার কারণে মে মাসে দেশের অর্থনীতিও মন্থর হয়ে পড়ে।
করোনাভাইরাস মহামারীর আগে ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে প্রায় ৪ কোটি পর্যটক ভ্রমণ করেছিলেন। এরপর থেকেই কমে গেছে ভ্রমণকারীর সংখ্যা।
বিশেষ করে, চীনের ভ্রমণকারীদের উল্লেকযোগ্য অংশ এখন আর থাই ভ্রমণে আসছেন না।
থাইল্যান্ডে পর্যটক কমছে কেন?
বাংলাদেশ, ভারতের মত দেশের কম খরচের পর্যটকদের জন্য প্রিয় গন্তব্য থাইল্যান্ড।
মূলত বিমান ভাড়া কম হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নাগরিকরা দেশটিতে ভ্রমণে যেতে আগ্রহী হন।
আরও পড়ুন– কম খরচে যেসব দেশে ঘুরতে যাবেন
তবে পর্যটন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিসা জটিলতাসহ নানা ভাবে পর্যটকদের থাইল্যান্ড যেতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
ঢাকার একজন পর্যটন ব্যবসায়ী রাশেকুর রহমান বলছেন, বাংলাদেশে অনেকে ভ্রমণের জন্য থাই ভিসা পাচ্ছেন না। যারা পাচ্ছেন তাদের মাস, দেড় মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
“যখন আপনার ভিসাই অনিশ্চিত থাকবে তখন ভ্রমণের পরিকল্পনা করবেন কিভাবে? ভিসার জন্য অনেকে বিমান টিকেট, হোটেল বুকিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যাংকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা রাখতে হচ্ছে, দালাল ধরতে হচ্ছে।”
এসব কারণে বাংলাদেশের পর্যটকরা এখন থাইল্যান্ডের পরিবর্তে মালদ্বীপের মত বিকল্প গন্তব্য খুঁজছেন, বলেন তিনি।
তবে থাইল্যান্ড সরকার বলছে, দেশটি এখন পর্যটনে সংখ্যার চেয়ে গুণমানে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
অর্থাৎ- বেশি টাকা খরচ করবে এমন পর্যটকদেরই স্বাগত জানাতে চাচ্ছে ব্যাংকক। বিনিময়ে তাদের জন্য রাখা হবে ‘প্রিমিয়াম’ সেবা।
থাইল্যান্ড পর্যটন কর্তৃপক্ষের গভর্নর থাপানি কিয়াতফাইবুল বলছেন, তারা ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে চাচ্ছেন।
তারা চান, ভ্রমণকারীরা প্রিমিয়াম হোটেল বুক করবে, চমৎকার সব খাবারের অভিজ্ঞতা নিবে এবং ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়বে।
ব্যাংককের একটি আন্তর্জাতিক হোটেল গ্রুপ মাইনর হোটেলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা ইয়ান ডি তুলিওর পর্যবেক্ষণ, বাজেট গন্তব্য হিসেবে থাইল্যান্ডের ধারণা ক্রমশ পুরানো হয়ে যাচ্ছে।
“সরকার বিমানবন্দরের মতো অবকাঠামোগত উন্নতি করছে। উচ্চ-গতির রেল প্রকল্প এবং ডিজিটাল ভিসা ব্যবস্থা চালু করছে। এসবের মাধ্যমে পর্যটন সেবাকে সহজ করছে। যাতে ধনীরা আকৃষ্ট হয়।”
বিলাসবহুল ভ্রমণকারীদের ব্যয় বেশি থাকলেও তা যে স্থানীয়দের জন্য লাভজনক হয় না, সেটিও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
ইয়ান ডি তুলিও বলেন, “পর্যটনের সঙ্গে একেবারে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষও জড়িত থাকেন। সব পর্যটককে রিসোর্টে নিয়ে গেলে এই মানুষগুলোর কি হবে?
“সকলের জন্য পর্যটন অভিজ্ঞতার সামগ্রিক মান উন্নত করা উচিত। স্থানীয় জনগণ, ব্যবসায়ী, পর্যটক- সবাইকে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।”
আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ‘মরিচীকার’ পিছনে ছুটছে; যা দেশটির পর্যটন খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে।
থাইল্যান্ডের মিনিংফুল ট্যুরিজম সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক উলফগ্যাং জর্জ আর্ল্ট বলছেন, পর্যটক আসা কমে যাওয়ার ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার এখন উন্নত দেশের দর্শনার্থীদের অজুহাত দাঁড় করাতে চাচ্ছে।
বৈশ্বিক অর্থনীতি, মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ- এসবের কারণে উন্নত দেশ থেকে চাহিদা অনুযায়ী পর্যটক আসব না বলেও মনে করেন তিনি।
উলফগ্যাং জর্জ আর্ল্টের পরামর্শ- সব ধরণের পর্যটককে বিবেচনায় রেখেই টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পর্যটন পরিকল্পনা সাজাতে হবে।
থাইল্যান্ডের দর্শনীয় স্থানগুলো
থাইল্যান্ডে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। দেশটির একেক অঞ্চলে একেক ধরণের সৌন্দর্য পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
নীচে থাইল্যান্ডের জনপ্রিয় কয়েকটি ভ্রমণ স্থানের তালিকা দেয়া হল।
ব্যাংকক:
রাজধানী হিসেবে, ব্যাংককে আধুনিক আকাশচুম্বী ভবন, গ্র্যান্ড প্যালেস এবং প্রাচীন মন্দির রয়েছে। ব্যস্ত বাজার, স্ট্রিট ফুড ও প্রাণবন্ত নাইটলাইফের জন্য ব্যাংকক দর্শনার্থীদের জন্য বিখ্যাত স্থান।
ফুকেট:
থাইল্যান্ডের বৃহত্তম দ্বীপ ফুকেট। সুন্দর সৈকত, ওয়াটার এক্টিভিটি ও নাইটলাইফের জন্য বিখ্যাত। পাটং বিচ, কাটা বিচ এবং কারোন বিচ এই দ্বীপের জনপ্রিয় স্থান।
ক্রাবি:
ক্রাবি প্রদেশে চুনাপাথরের পাহাড়, নির্মল সৈকত এবং প্রাণবন্ত প্রবাল প্রাচীর- দর্শকদের মুগ্ধ করে। রায়লে বিচ, আও নাং বিচের মতো স্থানগুলো সমুদ্র সৈকত প্রেমীদের জন্য ক্রাবিকে স্বর্গরাজ্য করে তুলেছে।
চিয়াং মাই:
দেশটির উত্তরে অবস্থিত চিয়াং মাই প্রাচীন মন্দির, হাতির অভয়ারণ্য এবং অনিন্দ প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত।
কোহ সামুই:
এই দ্বীপটি তার সুন্দর সৈকত, ফিরোজা রংয়ের পানি, নানা ধরণের ওয়াটার এক্টিভিটির জন্য পরিচিত।
ফি ফি দ্বীপপুঞ্জ:
এই দ্বীপপুঞ্জগুলো তাদের অত্যাশ্চর্য দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত। স্বচ্ছ নীল জল, স্নোরকেলিং, স্কোবা ডাইভিং- সব মিলিয়ে ভ্রমণের আদর্শ স্থান ফি ফি দ্বীপপুঞ্জ।
খাও লাক:
ফুকেটের উত্তরে অবস্থিত খাও লাক একটি শান্ত-নিরিবিলি এলাকা। সুন্দর সৈকত, উদ্যান, ডাইভিং, স্নোরকেলিং- সবকিছিুর জন্য উপভোগ্য গন্তব্য খাও লাক।
পাতায়া:
পাতায়া থাইল্যান্ডের একটি প্রাণবন্ত উপকূলীয় শহর। সুন্দর সৈকতের পাশাপাশি রাতের পাতায়া আপনাকে মুগ্ধ করবে।