বম লোককাহিনি- চিংড়ির কাণ্ড

চিংড়ি ছোটগল্প

সব্যসাচী পাহাড়ী

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক গ্রামে বাস করত এক লোক। একদিন লোকটা গেল এক ঝিরিতে। সেই ঝিরিতে ছিল একটা চিংড়ি মাছ। লোকটা যখন ঝিরিতে পা ধুতে গেল তখন চিংড়ি মাছটা লোকটার পায়ে বসাল একটা কামড়। লোকটা চিংড়ির কামড় খেয়ে প্রথমে খুব পাত্তা দিল না। কিন্তু একটু পরে চিংড়িটা একই পায়ে আরেকটা কামড় বসাল। দ্বিতীয়বার কামড় খেয়ে লোকটা দিশেহারা হয়ে দৌড়াতে লাগল। লোকটা যে রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছিল সেখানে ছিল একটা কুমড়োর মাচাং। সেই মাচাংয়ে তখন একটা কুমড়ো ঝুলছিল। লোকটার মাথায় লেগে তখনই কুমড়োটা গেল পড়ে। আর কুমড়োটা পড়ল গিয়ে একটা হরিণের উপর। হরিণটা এতে ভীষণ ভয় পেল। কোনোদিকে না তাকিয়ে হরিণটাও দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে হরিণটা গিয়ে পড়ল একটা ময়ূরের উপর। ময়ূর বেচারা তখন খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল। হরিণটা হঠাৎ এসে সবকিছু মাটি করে দিল। এমনকি ময়ূরের সুন্দর পাখাটা দিল ভেঙে। পাখা হারিয়ে ময়ূর নিজেকে নিজেই চিনতে পারছিল না। রাগে দুঃখে তখন সে অস্থির হয়ে উঠল। ময়ূর তখন দিশে হারিয়ে ছুটতে লাগল। ময়ূর যেদিক দিয়ে যাচ্ছিল সেই দিকটাতে একটা ভাল্লুক বসেছিল। ভাল্লুকটা ছিল ভীষণ বদমেজাজি। তবে পাখাবিহীন ময়ূরকে দেখে ভাল্লুকটা ভীষণ ভয় পেল। ময়ূরটাকে তো একটুও চেনা যাচ্ছে না। ভয় পেয়ে ভাল্লুকটা একলাফে উঠে গেল পাশের একটা চালতা গাছে। ভাল্লুকটা চালতা গাছে উঠার সাথে সাথে মড়াৎ করে চালতা গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়ল। সেই ডালে ছিল একটা চালতা। ভাল্লুক কোনোমতে চালতা গাছের অন্য একটা ডাল ধরে ঝুলে রইল। এদিকে চালতা গাছের ডালটা যখন পড়ল, তখনই চালতা গাছের নিচে একটা হাতি বসা ছিল। ডাল ছিঁড়ে চালতাটা গিয়ে পড়ল কিনা হাতির কানের ভিতর। হাতি তখন ভয়ে লাফাতে লাগল। ওর বিশাল শরীরের ভারে তখন চারদিক কাঁপছিল। হাতিটা বেসামাল হয়ে রাজার বাড়ির সামনে গিয়ে লাফাতে লাগল। এদিকে রাজকন্যা তখন কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরের ঘরে যাচ্ছিল। হাতির লাফালাফিতে মড়াৎ করে কাঠের সিঁড়ি গেল ভেঙে। রাজকন্যা তখনই পড়ে গেল নিচে। তখন রাজকন্যার একটা পা ভেঙে গেল।

কথাটা নিমিষে ছড়িয়ে পড়ল সারা রাজ্যে। রাজাও শুনলেন যে হাতির দাপাদাপিতে সিঁড়ি ভেঙে রাজকন্যার পা ভেঙে গেছে। রাজা তখনই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হাতির এত বড় সাহস! যাও হাতিটাকে এখনই ধরে নিয়ে এসো। রাজার আদেশে সৈন্যরা যে যেদিকে পারে ছুটল হাতিটাকে ধরে আনতে। অবশ্য হাতিটাকে ধরে আনতে ওদের খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। বেচারা হাতি তখন বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। সৈন্যরা হাতিটাকে ধরে বেঁধে নিয়ে এলো রাজার কাছে। বিশাল হাতিটা রাজার সামনে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রাজা বললেন, তুমি কি জানো তুমি কী অপরাধ করেছ? হাতি বলল, মহারাজ, আমার কোনো দোষ নেই। আমার কানে যদি চালতা না ঢুকত তবে কি আর আমি এই ধরনের অপরাধ করতাম? সব দোষ ঐ চালতার। রাজা বললেন, চালতাটা কোথায়? হাতি বলল, মহারাজ ওটা এখনও আমার কানে ঢুকে বসে আছে। রাজা হাতির কান থেকে চালতাটাকে বের করতে সৈন্যদের আদেশ দিলেন। শত শত সৈন্য এসে প্রথমেই হাতির চারটা পা শক্ত করে ধরল। কয়েকজন সৈন্য একজন অন্যজনের কাঁধে চড়ে হাতির কানের কাছে পৌঁছাল। তারপর একজন সাহসী সৈন্য হেঁচকা টান মেরে হাতির কান থেকে চালতাটা বের করে নিয়ে এলো। দুজন সৈন্য চালতাটাকে রাজার সামনে নিয়ে এলো। রাজা বললেন, চালতা তুমি অনেক অন্যায় করেছ। তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। চালতা সবিনয়ে বলল, মহারাজ, আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ভাল্লুকের। ভাল্লুক গাছে উঠতেই ডাল ভেঙে আমি পড়ে গেলাম। আর কী করে যে হাতির কানে ঢুকে গেলাম তা নিজেও জানি না। আপনি ভাল্লুককে শাস্তি দিন। রাজা সৈন্যদের আদেশ দিলেন ভাল্লুককে ধরে আনতে। সৈন্যরা তখন ভাল্লুকটাকে ধরে টেনে হিঁচড়ে রাজার কাছে নিয়ে এলো। রাজা বললেন, ভাল্লুক তোমার জন্য রাজকন্যা পা ভেঙেছে। তোমাকে এখন শাস্তি পেতে হবে। ভাল্লুক বলল, মহারাজ আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ময়ূরের। ময়ূর যদি ওভাবে না দৌড়াত তবে কি আমি ভয় পেতাম? ওর কিম্ভুতকিমাকার চেহারা দেখে ভয়ে আমি চালতা গাছে উঠে গিয়েছিলাম। রাজা এবার সৈন্যদের আদেশ দিলেন, যাও এখনই ময়ূরটাকে ধরে নিয়ে এসো। রাজার সৈন্যরা এবার ময়ূরকে ধরে নিয়ে এলো। ময়ূর এসেই রাজাকে বলল, মহারাজ দেখুন হরিণ আমার চেহারার কী হাল করেছে। আপনি হরিণকে শাস্তি দিন মহারাজ। রাজা এবার সৈন্যদের বললেন, যাও দেরি না করে এখনই হরিণকে ধরে নিয়ে এসো। সৈন্যরা ছুটল হরিণকে ধরে আনতে। হরিণ তখন দৌড়াচ্ছিল। সৈন্যরা একটা জাল ছুড়ে মারল হরিণের উপর। হরিণটা তখনই জড়িয়ে গেল জালে। সৈন্যরা জালসহ হরিণটাকে রাজার সামনে নিয়ে এলো। রাজা বললেন, হরিণ তুমি অনেক বড় অন্যায় করেছ। তোমার শাস্তি সম্পর্কে কি তোমার কোনো ধারণা আছে? হরিণ মায়াবী চোখে রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, মহারাজ আমার কোনো দোষ নেই। রাজা বললেন, হরিণ তুমি কি ভেবেছ তোমার মায়াবী চোখের দিকে তাকিয়ে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব? হরিণ বলল, বিশ্বাস করুন মহারাজ। আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ঐ কুমড়োর। ওটা যদি আমার গায়ে এসে না পড়ত তবে কি আমি ময়ূরের এমন ক্ষতি করতাম! সব দোষ ঐ কুমড়োর। আপনি কুমড়োটাকে শাস্তি দিন মহারাজ। রাজা সৈন্যদের আদেশ দিলেন কুমড়োকে নিয়ে আসতে। সৈন্যরা কুমড়োটাকে নিয়ে এলো রাজার কাছে। রাজা কুমড়োকে বললেন, সত্যি কথা বলো, তুমি কেন হরিণের উপর পড়ে গিয়েছিলে? কুমড়ো বলল, মহারাজ আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ঐ বুড়ো লোকটার। যে কিনা দৌড়ে যাবার সময় আমাকে প্রচণ্ড আঘাত করেছে। ওর আঘাতে আমি পড়ে যাই। আপনি ঐ লোকটাকে শাস্তি দিন। রাজা সৈন্যদের বললেন, যাও এখনই ঐ বুড়োকে ধরে নিয়ে এসো। সৈন্যরা অনেক খুঁজেটুজে বুড়োকে ধরে নিয়ে এলো। বুড়ো লোকটা রাজার সামনে এসে থরথর করে কাঁপছিল। রাজা বললেন, তুমি কি জানো, তোমার অপরাধের জন্য তোমার কী শাস্তি অপেক্ষা করছে? বুড়ো বলল, মহারাজ, আমাকে ক্ষমা করুন। আমার কোনো দোষ নেই। সব দোষ ঐ চিংড়ির। ঐ চিংড়ির কামড় খেয়ে আমাকে দৌড়াতে হয়েছে। ঐ চিংড়ি সবকিছুর জন্য দায়ী। রাজা তখন আদেশ দিলেন চিংড়িটাকে ধরে আনতে। ঝিরির সামনে থেকে সৈন্যরা চিংড়িটাকে ধরে আনল। রাজা বললেন, পুঁচকে চিংড়ি, তোমার জন্য রাজ্যে কত অঘটন ঘটে গেছে তুমি কি জানো? চিংড়ি নিশ্চুপ। রাজা এবার হুঙ্কার দিয়ে বললেন, কথা বলছ না কেন চিংড়ি? তারপরও চিংড়ি কোনো কথা বলল না। রাজা বুঝতে পারলেন সবকিছুর মূলে এই চিংড়ি। সেইই সবকিছুর জন্য দায়ী। রাজা তখন আদেশ দিলেন এক মণ চালের সাথে চিংড়িটাকে রান্না করতে। সবাই মিলে ঠিক করল পাশের এক বুড়ির বাড়িতে রান্না করা হবে। সবাই নেমে গেল বুড়িকে সাহায্য করতে। প্রথমে বানানো হলো বিশাল একটা চুলো। তারপর বিশাল একটা হাঁড়িতে এক মণ চাল দিয়ে হাঁড়ি বসানো হলো চুলার উপর। হাঁড়িতে যখন ভাত ফুটছিল তখন হাঁড়ির মধ্যে চিংড়িটাকে ফেলে দেয়া হলো। সৈন্যরা হাঁড়িতে চিংড়ি ফেলে বের হয়ে এল বুড়ির বাড়ি থেকে। আসার সময় বুড়িকে বলল, ভাত পুরোপুরি সিদ্ধ হলে আমাদের খবর দিও। বুড়ি বলল, আচ্ছা। সৈন্যরা বের হবার পর বুড়ি একটা হাতল দিয়ে ভাত নাড়ছিল। তখনই হাতলে চিংড়ি মাছটা উঠে এলো। বুড়ি চিংড়িটাকে দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। সে তখনই চিংড়িটাকে খেয়ে ফেলল। এদিকে ভাত সিদ্ধ হয়ে যাবার পর বুড়ি  সৈন্যদের খবর দিল। সবাই এসে ধরাধরি করে হাঁড়িটা নিয়ে গেল রাজবাড়িতে। রাজা বললেন, চিংড়িটাকে বের করে আমার সামনে রাখো। তখনই সবার ঘাম ঝরতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে আর চিংড়ির দেখা নেই। রাজা রেগে আগুন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোমাদের সবকটার গর্দান যাবে। ভয়ে তখন সবার মুখ চুপসে গেল। এদিকে বুড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে গান গাইতে লাগল।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক