ইঞ্জি. মো. মাঈয়ান
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প (SME) খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে।
এই খাতের বিকাশ, উদ্যোক্তা তৈরি ও শিল্প ভিত্তিক কর্মসংস্থানের পেছনে যে সরকারি প্রতিষ্ঠানটির অবদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- সেটি হলো বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)।
১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থা দেশের ৮৫টি শিল্পনগরী পরিচালনার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের প্লট বরাদ্দ, অবকাঠামো সহায়তা, প্রশিক্ষণ, কাঁচামাল সরবরাহ, উৎপাদন ও বিপণনসহ নানা ধরণের সেবা দিয়ে আসছে।
বর্তমানে সরকার বিনিয়োগ বান্ধব কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে বিডা (BIDA), বেজা (BEZA), বেপজা (BEPZA) ও হাইটেক পার্ক অথরিটিকে একীভূত করে একটি কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষ (Integrated Investment Authority) গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
তবে জানা যাচ্ছে, বিসিককে এই কাঠামোর বাইরে রাখার একটি প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে; যা বাস্তবতা, যুক্তি ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কৌশলগত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিসিকের শিল্পনগরীগুলোতে বর্তমানে মোট ১১,২৭১টি প্লট বরাদ্দ হয়েছে এবং এসব প্লটে প্রায় ৬,২৯,৭৭৬ জনের সরাসরি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
এছাড়া বিসিক পরিচালিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার উদ্যোক্তা ও কারিগরি শ্রমিক গড়ে ওঠে, যারা পরবর্তীতে উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহ চেইনের সঙ্গে যুক্ত হয়।
এই শিল্পনগরীগুলোর আশপাশে গড়ে ওঠা উপ-কারখানা, কাঁচামাল সরবরাহকারী ও পরিবেশন প্রতিষ্ঠানসমূহ বিসিককে কেন্দ্র করে ফরওয়ার্ড ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ তৈরি করেছে।
অর্থাৎ, একটি সম্পূর্ণ শিল্পিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে বিসিক একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করছে; যেখানে পেছনের কারখানা উপকরণ যোগান দেয়, আর সামনের প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চূড়ান্ত রপ্তানিযোগ্য পণ্য।
বিসিক শুধুমাত্র একটি সেবাদানকারী সংস্থা নয়, এটি সরকারকে উল্লেখযোগ্য রাজস্বও প্রদান করে থাকে।
বিসিকের ২০২৩–২৪ অর্থ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজস্ব আদায় (ভ্যাট, শুল্ক, কর ইত্যাদি) প্রায় ৪৪২৯ কোটি টাকার কাছাকাছি।
রাজস্ব উৎসের মধ্যে রয়েছে প্লট ভাড়া, ইউটিলিটি চার্জ, লাইসেন্স ফি, ট্রেড সার্ভিস ও অন্যান্য সহায়ক সেবা।
বিসিকের আওতাধীন শিল্পনগরী থেকে তৈরি পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য, প্লাস্টিক ও রাবার সামগ্রী, হালকা প্রকৌশল পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য এবং হস্তশিল্পজাত পণ্য।
এসব পণ্যের একটি বড় অংশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, যার অনেকটাই বিসিক কারখানাগুলো থেকে উৎসরূপে তৈরি হয়, যদিও রপ্তানিকারক হিসেবে নাম থাকছে তৃতীয় পক্ষের।
একীভূত কাঠামোয় বিসিকের প্রয়োজনীয়তা কী?
এক দরজায় সেবা নিশ্চিত করতে এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হ্রাসে কেন্দ্রীয় বিনিয়োগ কাঠামো গঠনের চিন্তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
তবে বিসিককে এই কাঠামোর বাইরে রাখা হলে মাঠ পর্যায়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই সংস্থাটি কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়বে।
ফলস্বরূপ, SME খাতে বিনিয়োগ উৎসাহ কমে যাবে, সেবা গ্রহণে বৈষম্য বাড়বে এবং উদ্যোক্তারা দ্বিধা ও বিভ্রান্তিতে পড়বেন।
অন্যদিকে, বিসিককে এই কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করলে যা যা সুবিধা পাওয়া যাবে তা হলো:
প্রশাসনিক সমন্বয় ও সেবা সহজীকরণ; প্রশিক্ষণ, প্লট বরাদ্দ ও রপ্তানি সহায়তা এক প্ল্যাটফর্মে; সুবিধা ভোগী উদ্যোক্তাদের জন্য এক-স্টপ সার্ভিস বাস্তবায়ন; SME খাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ উৎসাহ বৃদ্ধি; আন্তর্জাতিক মানে বিসিক শিল্পনগরী উন্নীতকরণ ও রপ্তানি বাজারে প্রবেশ।
বিসিক একটি প্রমাণিত ও দক্ষ মাঠ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে দীর্ঘ দিন ধরে দেশের ৬৪ জেলায় শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন পরিচালিত হচ্ছে।
সরকার যদি সত্যিই একটি সমন্বিত ও কার্যকর বিনিয়োগ কাঠামো চায়, তাহলে বিসিককে এর বাইরে রাখা উচিৎ হবে না।
বরং একীভূত কাঠামোর একটি শক্তিশালী স্তম্ভ হিসেবে বিসিককে অন্তর্ভুক্ত করা হলে দেশের SME খাত, রপ্তানি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে একটি যুগান্তকারী সাফল্য অর্জিত হবে।
লেখক: নির্বাহী প্রকৌশলী (ভাপ্রাপ্ত), বিসিক চামড়া শিল্পনগরী, ঢাকা