প্রথমে ফ্রান্স, তারপর যুক্তরাজ্য, এরপর কানাডা- প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলো একে একে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে।
এই ঘোষণাগুলো এসেছে এমন এক সময়ে, যখন গাজায় মানবিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই একাকী হয়ে পড়ছে।
ফিলিস্তিনকে কয়টি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে?
ইতোমধ্যে ১৪০টিরও বেশি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডার সিদ্ধান্ত এই তৎপরতায় নতুন গতি এনেছে।
আন্তর্জাতিকভাবে এই স্বীকৃতিগুলো প্যালেস্টিনীয়দের জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক জয় হলেও তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাংখা বাস্তবায়ন এখনো অনেক কঠিন।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
ফিলিস্তিন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে কিনা- বিশ্ব মোড়ল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র বহু বছর ধরেই ইসরায়েলের প্রধান মিত্র। কিন্তু এবার পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। বাইডেন প্রশাসন মানবিক বিপর্যয়ে উদ্বিগ্ন হলেও নেতানিয়াহু সরকারের অবস্থান বদলাতে পারেনি।
অন্যদিকে গাজা ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ওপর প্রকাশ্যে হতাশা প্রকাশ করেছেন। যখন গাজায় খাদ্য সংকট ও অপুষ্টিতে শিশুদের মৃত্যুর চিত্র সামনে আসতে শুরু করে তখন ট্রাম্পকে নেতানিয়াহুর প্রতি বেশ বিরক্ত হতে দেখা যায়।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানে মৃতের সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে নোবেল পুরস্কার জেতার স্বপ্ন দেখেন। তিনি চান সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করুক, যেমনটা তিনি প্রথম মেয়াদে আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে কিছু আরব দেশের সঙ্গে করেছিলেন।
কিন্তু রিয়াদ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ছাড়া এই চুক্তিতে আসবে না।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কেমন হবে?
এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে জটিল। কারণ, বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় একটি দেশ তখনই ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচিত হয়- যদি তার নির্ধারিত ভূখণ্ড, স্থায়ী জনসংখ্যা, কার্যকর সরকার ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা থাকে।
এই সবগুলো মানদণ্ড পূরণ না করলেও অনেক রাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কারণ এটিকে তারা ন্যায্যতার দাবি হিসেবে দেখে।
১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর লক্ষ লক্ষ প্যালেস্টিনীয় ঘরছাড়া হন। ১৯৬৭ সালের ‘সিক্স ডে ওয়ার’ এর পর ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম, পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে। তখন থেকে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে।
১৯৯০-এর দশকের ওসলো চুক্তিতে সম্ভাব্য রাষ্ট্রের একটি কাঠামো আঁকা হয়েছিল, যার ভিত্তি ছিল ১৯৬৭ সালের সীমারেখা।
কিন্তু এরপর থেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি বিস্তার এতটাই বেড়েছে যে, ভূখণ্ডগতভাবে একটি ‘যোগাযোগযোগ্য’ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্যালেস্টাইনকে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু পশ্চিমা দেশ বরাবরই পিছপা থেকেছে। তারা বলছে, এ ধরনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়েই আসা উচিত। কিন্তু গত কয়েক দশকে কোন চুক্তিই আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে ফিলিস্তিনে দুটি আলাদা প্রশাসন রয়েছে। বর্তমানে পশ্চিম তীর শাসন করছে মাহমুদ আব্বাসের প্যালেস্টাইন অথরিটি- যাকে অনেকেই অজনপ্রিয়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বল মনে করেন।
অন্যদিকে গাজায় রয়েছে হামাস, যারা ইসরায়েলের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে। এই দলটিকে আবার বহু দেশ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। এসব দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার সঙ্গে হামাসকে ক্ষমতার বাইরে রাখার শর্ত দিচ্ছে।
ফলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র কে পরিচালনা করবে, তা নিয়েও রয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা।
আর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু স্পষ্ট বলেছেন, তিনি প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকে মেনে নিবেন না। এমনকি তার মন্ত্রিসভার কট্টর ডানপন্থীরা সরাসরি বলছেন, তারা গাজার মানুষকে খাবার না দিয়ে মরতে দেবে, কিন্তু কোনভাবেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে না।
এই অবস্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলকে ক্রমশ আরও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশ এখন মনে করছে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ছাড়া শান্তি অসম্ভব।
আন্তর্জাতিক চাপ বনাম ইসরায়েলি প্রতিরোধ
ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও কানাডার স্বীকৃতির ঘোষণা নেতানিয়াহু সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও, বাস্তবে তার প্রভাব খুবই সীমিত। বরং এই ঘোষণা ইসরায়েলের বর্তমান নেতৃত্বকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলতে পারে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ বাড়ছে তার মিত্রদের কাছ থেকে। এমন পরিস্থিতিতে যদি ট্রাম্প নিজের অবস্থান পরিবর্তন না করেন, তাহলে ইসরায়েল নিজেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে।
যাই হোক- আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে থাকা প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের ধারণাটি এখনো কেবল কূটনৈতিক আলোচনার কল্পচিত্রেই সীমাবদ্ধ। গাজার ভেতরের বাস্তবতা, নেতানিয়াহুর অনমনীয় নীতি এবং ফিলিস্তিনে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব- সব মিলিয়ে প্যালেস্টিনীয়দের ‘রাষ্ট্র’ এখনো অনেক দূরের স্বপ্ন।
তবে বিশ্ব জনমত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তরুণরা সোচ্চার হচ্ছেন, সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তুলছেন, পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে, এমনকি জাতিসংঘেও প্যালেস্টাইনের পক্ষে আওয়াজ জোরালো হচ্ছে।
ইতিহাস বলে- পরিবর্তন হঠাৎই আসে, যদিও তাতে সময় লাগে।
