রক্তদানের উপকারিতা, আগে-পরে করণীয়

রক্তদান সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আজকের আয়োজন।

কেন রক্ত দেয়া উচিত?

নিরাপদ রক্ত মানুষের জীবন বাঁচায়। গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালীন জটিলতা, অস্ত্রোপচার, দুর্ঘটনা, রক্তাল্পতা, ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়া- এরকম নানা ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়।

আমেরিকান রেড ক্রসের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ২ সেকেন্ডে কারও না কারও রক্তের প্রয়োজন হয়। আর যুক্তরাজ্যে বছরে ১ লাখ ৪৩ হাজার নতুন রক্তদাতার প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশ ও ভারতের মত জনবহুল দেশে রক্তের এই চাহিদা আরও বেশি।

যেহেতু প্রতিদিন প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়- তাই রক্তদান হতে পারে অন্যকে দেয়া আপনার সবচেয়ে মূল্যবান উপহার।

আপনার রক্তদান একাধিক মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। কারণ, একবার রক্ত দিলে তা একসঙ্গে ৩ জনের জীবন বাঁচাতে ব্যবহার হতে পারে।

এর পাশাপাশি রক্তদান আপনার জন্যও বেশ উপকারি হতে পারে।

রক্তদানের উপকারিতা

রক্তদান আপনাকে শারিরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকতে সাহায্য করতে পারে।

বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা

রক্ত নেয়ার আগে এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি এবং সিফিলিসের মতো কিছু টেস্ট করা হয়।

এসব পরীক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি রক্তদানের জন্য ফিট আছেন কিনা, তা দেখা হয়।

তাই, রক্তদানের সুবাদে আপনার শরীরে গোপনে কোন সংক্রমণ বাসা বেঁধেছে কিনা- সেটি জানতে পারবেন।

কোন সংক্রমণ থাকলে চিকিৎসা করার সুযোগ পাবেন।

সুস্থ হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালী ব্যবস্থা

নিয়মিত রক্তদান রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েল কর্ণেল মেডিকেল সেন্টারের ট্রান্সফিউশন মেডিসিনের পরিচালক রবার্ট ডেসিমোন বলেন, যদি রক্তে হিমোগ্লোবিন খুব বেশি হয়, তাহলে রক্তদান রক্ত জমাট বাঁধা, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।

এছাড়া বংশগত হিমোক্রোমাটোসিস নামক একটি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে খুব বেশি রক্ত তৈরি করে।

আয়রন জমা হওয়া রোধ করার জন্য নিয়মিত রক্ত অপসারণ করা উচিত, এই রক্ত আবার অন্যদের উপকার করতে পারে।

সুখী ও দীর্ঘ জীবন

রবার্ট ডিসিমোনের মতে, একটি রক্তদান তিনটি জীবন পর্যন্ত বাঁচাতে পারে।

এসবের মাধ্যমে রক্তদাতার ভালো লাগে; যা বিষণ্ণতার ঝুঁকি কমায়।

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আরভিং মেডিকেল সেন্টারের সহকারী পরিচালক সারাহ ভসোফি জানান- রক্তদান শারিরিক, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রেখে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।

“যারা রক্ত দেয় তাদের স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং তারা দীর্ঘজীবী হয়।”

রক্ত দেয়ার আগে-পরে করণীয়

রক্তদানের পরিকল্পনা করলে তার আগে ও পরে কিছু পদক্ষেপ নিন।

১. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন।

রক্তদানের আগে-পরে পর্যাপ্ত পানি খেলে দুর্বল লাগা, মাথা ঝিম ধরা, মাথা ঘুরানোর মত সমস্যা তৈরি হয় না।

সেক্ষেত্রে পানি, ডাব, স্যালাইন, শরবত, তরল খাবার গ্রহণ করতে পারেন।

২. রক্তদানের আগে ভালো করে খেয়ে নিন।

তাহলে রক্ত দেয়ার পরে শরীরে কোন দুর্বলতা অনুভব করবেন না।

৩. রক্তদানের আগের রাতে ভালো করে ঘুমিয়ে নিন। চেষ্টা করুন যাতে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুম হয়।

৪. রক্তদানের পর ১০ থেকে ১৫ মিনিট বিশ্রাম নিন। এটি আপনাকে শারিরিক পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করবে।

৫. রক্তদানের পর পর্যাপ্ত পানি পান করুন এবং হালকা নাস্তা খেয়ে নিন। তাতে নিজেকে শারিরিকভাবে দুর্বল অনুভব করবেন না।

৪. রক্ত দেয়ার পরের ২৪ ঘণ্টায় ভারি কাজ, অতিরিক্ত পরিশ্রম, ব্যায়াম করা থেকে বিরত থাকুন।

না হলে মাথা ঘুরার মত সমস্যা হতে পারে।

৪. আয়রন ট্যাবলেট খেতে পারেন।

রেড ক্রসের মত প্রতিষ্ঠান যারা রক্ত দেন তাদের আয়রন সাপ্লিমেন্ট বা আয়রনযুক্ত মাল্টিভিটামিন খাওয়ার পরামর্শ দেয়।

বিশেষ করে কিশোরদের আয়রন গ্রহণ করা উচিত, না হলে রক্তদানের পরে তাদের আয়রনের ঘাটতি হতে পারে।

সাপ্লিমেন্ট নিতে না চাইলে আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন।

রক্ত দেয়ার সময় কেমন লাগে? রক্ত দিতে কত মিনিট লাগে?

নিঃস্বার্থভাবে কাউকে রক্ত দিলে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে।

আর রক্তদান করা খুবই সহজ। রক্ত নেয়ার আগে আপনার রক্তের কিছু টেস্ট করা হবে। এতে আধা ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।

টেস্টে কোন সমস্যা ধরা না পরলে আপনাকে রক্ত গ্রহণের রুমে নেয়া হবে।

এরপর প্রথমে বিছানায় শুইয়ে হাতের শিরায় সুই ঢুকানো হবে। এসময় আপনার শিরায় পিপড়ার কামড়ের মত অনুভূতি হতে পারে।

এরপর পাইপ বেয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে রক্তের ব্যাগ ভরে যাবে।

রক্তদান খুবই নিরাপদ এবং রক্তদানের সময় বা পরে অস্বস্তি অথবা কোন সমস্যা হওয়া খুবই অস্বাভাবিক।

রক্ত দেয়ার পর ১০ থেকে ১৫ মিনিট বসে বা শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে, হালকা পানি বা তরল খাবার গ্রহণ করে স্বাভাবিক কাজে ফিরে যেতে পারবেন।

তবে দিনের বাকি সময় পরিশ্রমের কাজ এড়িয়ে যাওয়া উচিত। পরবর্তী ২৪ ঘণ্টা প্রচুর পরিমাণ তরল পান করুন।

কি পরিমাণ রক্ত দিতে হয়? রক্ত কি কমে যায়?

সাধারণত একজনের শরীর থেকে ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত নেয়া হয়, যা আমাদের মোট রক্তের পরিমাণের ১০ শতাংশেরও কম। কারণ একজন প্রাপ্তবয়স্কের শরীরে গড় রক্ত প্রায় ৫ লিটার হয়ে থাকে।

যে পরিমাণ রক্ত দেয়া হয়, তা ৩৬ ঘন্টার মধ্যেই আমাদের শরীরে স্বাভাবিকভাবে ফিরে আসে।

কারা রক্ত দিতে পারে?

সুস্থ ব্যক্তি এবং যাদের রক্তের মাধ্যমে অন্যের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নেই- তারা রক্ত দিতে পারবেন।

সাধারণত ১৭ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের রক্ত নেয়া হয়ে থাকে।

সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি প্রতি ৩ মাস পর পর রক্ত দিতে পারেন, সে হিসেবে সুস্থ ব্যক্তি কোন রকম ঝুঁকি ছাড়াই বছরে ৪ বার রক্ত দিতে পারবেন।

কারা রক্ত দিতে পারবেন না?

রক্ত দিলে যার নিজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে- তিনি রক্ত দিতে পারবেন না।

এছাড়া,

> অসুস্থ বোধ করলে

> রক্তাল্পতাজনিত সমস্যায় ভুগলে

> গর্ভবতী হলে

> অথবা বুকের দুধ খাওয়ালে আপনি রক্ত দিতে পারবেন না।

পাশাপাশি কিছু শারীরিক অবস্থা রয়েছে যখন ব্যক্তি রক্ত দিতে পারেন না।

এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক এবং বিশেষ কিছু ওষুধ ও টিকা গ্রহণের সময় আপনি রক্ত দিতে পারবেন না।

কিছু রোগের কারণেও আপনি রক্তদানের অনুপযোগী হতে পারেন। যেমন- এইচআইভি বা সিফিলিস।