একটি অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের দিকে এগুচ্ছে কাবুল ও নয়াদিল্লী। রাখঢাক না রেখেই ভারত ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা অনেককে অবাক করলেও এটিই এখন বাস্তবতা।
তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দিলেও কূটনৈতিকভাবে কাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে ভারত।
পশ্চিমা বিশ্ব যখন তালেবানদের এড়িয়ে চলছে, তখন তাদের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা তৈরির চেষ্টা আলাদাভাবে নজরে আসছে।
এই তৎপরতা বিস্ময় তৈরির কারণ হলো- ভারত ও তালেবানের অতীত সম্পর্ক।
একইসঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে আছে বিজেপি, যে দলটির বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করতে গিয়ে মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে তালেবানের বিরুদ্ধে রয়েছে কট্টর ইসলামপন্থী রাজনীতির অভিযোগ।
বিপরীতধর্মী অবস্থান পিছনে রেখে- ভারত কিভাবে তালেবানের বিষয়ে তাদের পুরনো অবস্থান থেকে সরে আসছে, সে আলোচনা এখন বিশ্লেষকদের মনোযোগ কাড়ছে।
ভারত, আফগানিস্তান ও তালেবানের সম্পর্ক
তালেবানের ক্ষমতা দখলের আগে আফগানিস্তান ছিল সোভিয়েত সমর্থিত মোহাম্মদ নজিবুল্লাহ সরকারের নিয়ন্ত্রণে। নজিবুল্লাহ সরকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে গিয়েছিল ভারতও।
নজিবুল্লাহ সরকারের পতনের পর কাবুলের নিয়ন্ত্রণ যায় তালেবানদের হাতে। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ভারত কাবুলের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়।
নয়াদিল্লী মনে করতো- তালেবান পাকিস্তানের গোয়েন্দাদেরই একটা ছায়া দল। যারা পাকিস্তানের সহযোগিতা নিয়ে মস্কো বিরোধী মুজাহিদদের একত্রিত করেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তান তালেবানদের শাসনে ছিল। গোটা সময় জুড়েই ভারত সরকার তাদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে অস্বীকৃতি জানায়।
অবশ্য সে সময় তালেবানরা মাত্র ৩টি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছিল। দেশ তিনটি হল- সৌদি আরব, পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত।
অভিযোগ রয়েছে, তালেবানের শাসনামলে নয়াদিল্লী দেশটিতে তালিবান বিরোধী গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিতে থাকে।
২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর ভারত আবার আফগানিস্তানে সম্পর্ক বাড়াতে থাকে।
কাবুলে আবার চালু হয় ভারতীয় দূতাবাস। নয়াদিল্লী হয়ে ওঠে আফগানিস্তানের উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী।
সেসময় ভারত আফগানিস্তানে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ বিনিয়োগ করে। যা ব্যয় হয়, আফগানদের অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রকল্পে।
এর বিপরীতে তালেবান ও তার সমমনা দলগুলোর ক্ষোভ বাড়তে থাকে ভারতের বিরুদ্ধে। ভারতীয় দূতাবাস শিকার হয় প্রাণঘাতি হামলার।
২০২১ সালের আগস্টে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভারত আবার আফগানিস্তান ছেড়ে যায়। কাবুল থেকে আরেক দফা দূতাবাস সরিয়ে নেয় ভারত সরকার। একইসঙ্গে তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে নয়াদিল্লী।
যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে ভারত ও তালেবান সম্পর্ক
তালেবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর ভারত কাবুল ছাড়লেও এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। প্রথমবার তালেবান ক্ষমতায় আসার পর ভারতের যে অবস্থান ছিল, এ দফা তা অনেকটাই আলাদা।
সব দুয়ার বন্ধ না করে ভারত সরকার এবার তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। প্রথমে এ তৎপরতা আড়ালে থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রকাশ্যে এসেছে।
তালেবানের শাসনব্যবস্থা নিয়ে বহু প্রশ্ন রয়েছে, যা তাদের বিশ্বজুড়ে কোনঠাসা করে রেখেছে।
এরপরও কিভাবে ভারত তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার দিকে এগুচ্ছে- সে বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের প্রয়োজনেই তালেবানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
কারণ ৩ দশক আগের ভারত, আর বর্তমানে ভারতের অবস্থান এক নয়। সময়ের অগ্রযাত্রায় ভারত এখন বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ এক শক্তি হিসেবে সমীহ আদায় করে নিতে আগ্রহী।
আর তা তখনই সম্ভব হবে, যখন আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নয়াদিল্লী অন্যদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে।
সে হিসেবে ভারত এখন সহজেই বুঝতে পারছে যে, তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে আগের দফায় তারা আফগানিস্তানের প্রভাব তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিল।
এখন এমন এক সময়ে ভারতকে তালেবানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখার প্রয়োজন অনুভব করতে হচ্ছে, যখন তাদের প্রতিদ্বন্ধি কেবল পাকিস্তান নয়।
ইতোমধ্যে আফগানিস্তানে প্রভাব তৈরি করতে পাকিস্তানের বাইরেও আগ্রহ দেখাচ্ছে চীন ও ইরান।
স্বীকৃতি না মিললেও সম্পর্ক এগিয়ে নিতে তালেবানের নীতি-নির্ধারকরা দেশ তিনটির নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করছে।
প্রতিবেশীদের এই দৌড়ে ভারতও আর পিছিয়ে থাকতে চাচ্ছে না, বলছেন বিশ্লেষকরা।
যেভাবে এগুচ্ছে ভারত-তালেবান সম্পর্ক
জাতিসংঘ ও এর কোন সদস্য দেশ এখন পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। স্বীকৃতি না দিলেও যে অল্প কয়টি দেশ কূটনৈতিকভাবে তালেবানের বন্ধু হতে চাচ্ছে, তার একটি ভারত।
তালেবান দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার ১ বছরেরও কম সময়ে ২০২২ সালের জুনে ভারত কাবুলে পুনরায় তাদের দূতাবাস খুলে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে, তালেবানরা মুম্বাইয়ে আফগান কনস্যুলেট খুলে, সেখানে একজনকে দায়িত্বও প্রদান করে।
গেল জানুয়ারিতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি তালেবানের শীর্ষ নেতা ও আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন।
দুবাইয়ের এই বৈঠকটিই এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মুখোমুখি আলোচনা।
এরপর এপ্রিলে আরেক দফা বৈঠক করেন দুই পক্ষের সরকারি প্রতিনিধিরা। আফগান সরকারের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনায় বসতে কাবুল উড়ে যান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন বিশেষ প্রতিনিধি।
আনন্দ প্রকাশ এই সফরে আমির খান মুত্তাকির সঙ্গেও কথা বলেন।
গেল ১৫ মে আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর। এটিই তালেবান সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের প্রথম ফোনালাপ।
কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় তালেবান সরকারের নিন্দার পর দুই নেতা ফোনে আলোচনা করেন।
এই ফোনালাপের পর দুই দেশের সরকারই অবিশ্বাসের সম্পর্ক ভেঙে সামনে এগুনোর বার্তা দেয়।
যা বলছেন বিশ্লেষকরা
ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক কবির তানেজা মনে করেন, তালেবানের মত একটি সংগঠন কাবুলের সরকারে থাকায়, তার সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ায় অনেকেই খুশি হতে পারছেন না।
কিন্তু কাবুলের রাজনৈতিক বাস্তবতা যা-ই হোক, তার মুখোমুখি না হওয়াটা যে ভারতের উচিত নয়- সেটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।
কবির তানেজা বলছেন, আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে ভারতের এক দশকের প্রচেষ্টা তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও, তা একেবারে ভেঙে পড়েনি।
“এমনকি তালেবানদের আদর্শিক দুর্গ দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসাও ভারতে অবস্থিত,” বলেন তিনি।
এই বিশ্লেষক বলছেন, সরকারে যে-ই আসুক, সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত দেশকেই বিবেচনায় নেয়া উচিত।
“সম্পর্ক হয় দেশের সঙ্গে দেশের, চরিত্র বদলালেও এসব সম্পর্ক হেরে যায় না। সম্পর্কগুলোকে বাস্তবসম্মতভাবে মোকাবেলা করা উচিত।”