জীবনের কোন না কোন সময় ঘাড় ব্যথা হয়নি, এমন মানুষ খুব কমই আছে। অর্থাৎ ঘাড়ে ব্যথা হওয়া আমাদের সাধারণ স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোর একটি।
নানা কারণে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে থাকতে পারে। জীবনযাপনে একটু পরিবর্তন আনলে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা ঘাড় ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে পারি।
তবে ঘাড় ব্যথা কখনো কখনো গুরুতর বিপদ ডেকে আনতে পারে, তাই সতর্ক ভাবে এ সমস্যার সমাধানে নজর দিতে হবে।
শুরুতে আমরা জেনে নিব ঘাড় ব্যথা কেন হয়, ঘাড়ে ব্যথার কারণ কি!
ঘাড় ব্যথার কারণ
ঘাড় ব্যথা অধিকাংশ সময়েই খুব সাধারণ কারণ থেকে হয়ে থাকে। আমাদের দৈনন্দিন কিছু অভ্যাসই ঘাড়ে ব্যথা তৈরি করে।
১. ঘুমের ভুল পদ্ধতি:
ঘুমের ভুল পদ্ধতি অনেক সময়ই ঘাড় ব্যথাকে ডেকে আনে।
- উঁচু ও শক্ত বালিশে ঘুমালে ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
- বিছানা শক্ত হলে কিংবা ফ্লোর বা কাঠের মত জায়গায় ঘুমালে পিঠের সঙ্গে ঘাড়েও ব্যথা হতে পারে।
- চেয়ার-টেবিল বা গাড়ির সিটে ঘুমিয়ে পড়লে তা ঘাড়ে যন্ত্রণার কারণ হতে পারে।
- ঘুমানোর সময় শরীর অসুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও ঘাড় ব্যথা হতে পারে।
২. ভুল ব্যায়াম:
সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে ভুলভাবে ব্যায়াম করলে তা শরীরের অন্যান্য অংশের মত ঘাড়েও ব্যথা তৈরি করতে পারে।
৩. আকস্মিক ঝাঁকুনি:
হঠাৎ করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তা ঘাড় ব্যথার কারণ হতে পারে।
যেমন হাঁটাচলা বা ব্যায়ামের সময় শরীর বেকায়দায় পড়ে যেতে পারে। তাতে শরীরের ঝাঁকুনি ঘাড়েও ব্যথা তৈরি করতে পারে।
হঠাৎ করে মাথা কোনদিকে ঘুরাতে হলে, তা ঘাড়ে চাপ ফেলতে পারে।
তেমনি পড়ে যাওয়া, খেলাধুলা, দুর্ঘটনা, গাড়ির হঠাৎ ব্রেক কষা, মনোযোগহীনতার মত কারণে ঘাড়ে ঝাঁকুনি লাগতে পারে। যা পরে হালকা থেকে তীব্র ব্যথার কারণ হতে পারে।
৪. ভুল ভঙ্গিতে কাজ করা:
কাজ করার সময় শরীরকে ভুল ভঙ্গিতে রাখলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
দীর্ঘক্ষণ ঝুঁকে কম্পিউটার ব্যবহার, ঘাড়ের উপর চাপ পড়ে- এমন অবস্থানে থেকে টানা মোবাইল ব্যবহার করার কারণে আধুনিক সময়ে অনেকেই ঘাড়ে ব্যথা অনুভব করেন।
ঝুঁকে হাঁটা, ভুল ভঙ্গিতে বসা, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে বা বসে টানা কাজ করা ঘাড় ব্যথার অন্যতম কারণ।
অর্থাৎ আপনার ঘাড়ের পেশিতে টান ধরে এমন যে কোন অবস্থাই ঘাড় ব্যথার কারণ হতে পারে।
৫. ঘাড়ে চাপ ফেলে এমন কাজ করা:
আমরা অনেক সময় ভারী জিনিস উপরে তুলে থাকি, এ ধরণের কাজ ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে।
আপনি যদি এমন কাজ করেন, যেখানে বারবার ঘাড় ঘুরাতে হয়- তাহলে ব্যথা হতে পারে। আবার টানা ঘাড় ঝুঁকে থাকলেও ব্যথা হতে পারে।
অর্থাৎ ঘাড়ের পেশিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন চাপের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
৬. আঘাত:
দুর্ঘটনা, খেলাধুলা, ব্যায়াম বা অন্য কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ঘাড়ে সরাসরি আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন। এ ধরণের ক্ষেত্রে সাধারণত ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব হয়ে থাকে।
৭. দুশ্চিন্তা:
মানসিক চাপ সরাসরি ঘাড়ের পেশিতে চাপ ফেলে। দীর্ঘ সময় মানসিক অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তার ভিতর দিয়ে গেলে তা ঘাড় ব্যথার কারণ হতে পারে।
কারণ, অস্থিরতা ঘাড়ের পেশিকে টানটান করে রাখে। আর এ অবস্থা দীর্ঘ সময় চললে তা যন্ত্রণা ডেকে আনতে পারে।
৮. বিশ্রামের অভাব:
বিশ্রামের অভাব শরীরকে ক্লান্ত ও দুর্বল করে তুলে। বিশ্রাম না নিয়ে টানা কাজ করতে থাকলে শরীর তার সক্ষমতার বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এর প্রভাব পড়ে সারা শরীরে, তাতে ঘাড়েও ব্যথা হতে পারে।
৯. পুষ্টির অভাব:
পুষ্টির অভাবে শরীরে নানা সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর ঘাটতি হলে হাড় দুর্বল হতে থাকে। এতে ঘাড়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে।
১০. শারীরিক সমস্যা:
বয়স বাড়লে আমাদের শরীরে হাড় ক্ষয়সহ বিভিন্ন ধরণের সমস্যা হয়ে থাকে।
ঘাড়ের পেশী, হাড়, স্নায়ু- ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঘাড়ে ব্যথা হয়। বয়স হলে মানুষের শরীরে এসব সমস্যা বাসা বাঁধতে পারে।
অনেকের ঘাড়ের অংশের মেরুদণ্ডের জয়েন্ট ও ডিস্কের ক্ষয় ঘটে। অনেকক্ষেত্রে ডিস্ক ফেটে যেতে পারে, সরে যেতে পারে, শুকিয়ে যেতে পারে। এসব সমস্যা চাপ ফেলে স্নায়ুতে। যা তীব্র ঘাড় ব্যথাসহ শরীরের অন্যান্য অংশে সমস্যার সৃষ্টি করে।
এছাড়াও বিরল ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ডসহ শরীরের অন্যান্য অংশের সমস্যার কারণে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। সংক্রমণ, টিউমার, মেনিনজাইটিস, ক্যান্সারের মত রোগও ঘাড় ব্যথার কারণ হতে পারে- যদিও খুব কম ক্ষেত্রেই ঘাড় ব্যথার জন্য এসব কারণ দায়ী হয়ে থাকে।
ঘাড় ব্যথা হলে করণীয়
যেসব কারণে আপনার ঘাড় ব্যথা হতে পারে, সেসব অভ্যাস থেকে দূরে থাকলেই অনেক ক্ষেত্রে আপনি ঘাড় ব্যথা এড়াতে পারবেন।
কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘাড় ব্যথার জন্য দায়ী হয় সাধারণ কিছু অভ্যাস। ঘাড় ব্যথা হলে কি করতে হবে- তা নীচে তুলে ধরা হলো।
- কাজ করা, হাঁটাচলা বা বসার সময় শরীরকে সঠিক ভঙ্গিতে রাখুন; চলাফেরায় সতর্কতা অবলম্বন করুন।
- ঘুমানোর সময় বালিশকে সঠিক অবস্থানে রাখুন, শরীর যাতে বেকায়দায় না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- নাগাড়ে কাজ করা থেকে বিরত থাকুন। একটু বিরতি নিয়ে শরীরের অবস্থান কিছু সময়ের জন্য পরিবর্তন করুন, হালকা করে হাত-পা নড়াচড়া করতে পারেন।
- মানসিক চাপ, অস্থিরতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করুন।
- পুষ্টিকর খাবার খান। পরিমিত পানি পান করুন। ভিটামিন ডি’র জন্য মাঝে মাঝে রোদে যান।
- প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিন। চাহিদা অনুযায়ী ঘুম নিশ্চিত করুন।
- প্রতিদিন কিছু সময় সঠিক পদ্ধতি শরীর চর্চা করুন।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘাড় ব্যথা বড় সমস্যার কারণ হয় না। সঠিক যত্ন ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলে সহজেই সুস্থ হয়ে ওঠা যায়।
এরপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
*সরাসরি কোন আঘাতের কারণে ঘাড়ে ব্যথা হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
*এছাড়া ঘাড়ের ব্যথা তীব্র হলেও ডাক্তার দেখাতে হবে।
*ব্যথা কম থাকলেও, তা যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে তাহলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
*ঘাড় ব্যথার সঙ্গে শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও সমস্যা অনুভব করেন কিংবা ঘাড় ব্যথার সঙ্গে জ্বর বা অন্যান্য জটিলতা দেখা দেয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।
*অন্যান্য রোগের কারণে ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার সন্দেহ করলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।