মালদ্বীপে বাংলাদেশিরা প্রতারিত হচ্ছেন যেসব কারণে

সাইফুল ইসলাম, মালে

বাংলাদেশ থেকে রিসোর্টে কাজ করার জন্য মালদ্বীপ এসেছিলেন কামাল আহমেদ। ঋণ করে এজেন্সিকে ৭ লাখ টাকা দিয়ে দেশটিতে আসেন তিনি।

কিন্তু মালদ্বীপে এসেই তার আশা ভঙ্গ হয়। কামাল আহমেদকে এখন নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতে হচ্ছে, ভারী মালামার ওঠানো তার জন্য খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।

কামালের মত আরও অনেকেই মালদ্বীপে এসে এভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। কষ্টকর কাজ করে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, বেতনও পাচ্ছেন কম। কিন্তু মোটা অংকের টাকা খরচ করে আসায় তারা দেশেও ফিরে যেতে পারছেন না।

এসব কারণে ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র মালদ্বীপ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার হলেও পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

দেশটি থেকে নিয়মিত বাংলাদেশিদের ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি অনেকে গ্রেপ্তারও হচ্ছেন।

এমন ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে মালদ্বীপ প্রবাসীদের মধ্যে।

তারা বলছেন, কিছু বাংলাদেশির অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন, যা বৈধ প্রবাসীদের ওপরও চাপ তৈরি হচ্ছে।

মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবস্থা

বিদেশিদের জন্য মালদ্বীপের শ্রমবাজার চালু হওয়ার পর থেকেই দ্বীপ দেশটিতে বাংলাদেশিদের চাহিদা বাড়তে থাকে। আইল্যাণ্ডে আইল্যাণ্ডে দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা।

রিসোর্ট, হোটেল, মাছ ধরা, আবাসন, ব্যবসাসহ নানা সেক্টরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে প্রবাসী বাংলাদেশিরা।

কাজের চাহিদা থাকায় বৈধ উপায়ের পাশাপাশি অবৈধভাবেও প্রচুর বাংলাদেশি ঢুকে পড়েন মালদ্বীপের শ্রমবাজারে।

ধারণা করা হয়ে থাকে, মালদ্বীপের মোট বাসিন্দাদের ২০ শতাংশই বাংলাদেশি।

তবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা লাখের ঘর পেরুনোর পর থেকেই সতর্ক হয়ে ওঠে মালদ্বীপ সরকার।

অবৈধ বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে লোক নেয়া প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

বিপরীতে দেশটিতে ভারত, শ্রীলংকা ও নেপালের প্রবাসীদের সংখ্যা বাড়ছে।

মালদ্বীপে বাংলাদেশিরা প্রতারিত হচ্ছেন কেন?

মালদ্বীপ প্রবাসীরা বলছেন, অবৈধভাবে মালদ্বীপে আসা ও কিছু বাংলাদেশির অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণে দেশটির সরকার এখন কড়াকড়ি অবস্থান নিয়েছে।

ফলে বিমানবন্দর থেকেই অনেক বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

সম্প্রতি ২ জন শিশু বাড়তি বয়স দেখিয়ে মালদ্বীপ এসে ভেলেনা বিমানবন্দরে ধরা পড়েছেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ঘটনা ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে।

৬ বছর ধরে মালে শহরে থাকা সোহরাব হোসেন বলছেন, তিনি দেশটিতে আসার পর থেকেই বাংলাদেশের অনেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

“বাংলাদেশে কাজের অভাব আছে। লোকজন বিদেশ আসতে চায়। এজন্য লাখ লাখ টাকাও খরচ করতে চায়।”

টাকা দিয়ে বিদেশে কাজ নেয়ার এই ফাঁদই বাংলাদেশিদের প্রতারিত করছে, মনে করেন তিনি।

সোহরাব হোসেন বলেন, “যখন টাকার গন্ধ থাকে, তখন দালাল তৈরি হয়। দালালরা কয়েক লাখ টাকা নিয়ে তাদের যেনতেনভাবে আনে। এরপর কাজ করতে থাকে, কিন্তু অভিযানে ধরা পড়লেই সব শেষ।”

এরপর কাউকে যেতে হয় জেলে, কেউ ফেরত যান ঢাকায়।

তিনি জানান, দালালরা বিভিন্ন গ্রামের সহজ-সরল লোকদের টার্গেট করে ফ্রি ভিসায় (এক কোম্পানির নামে এসে অন্য কোম্পানিতে কাজ করা) মালদ্বীপে আনছে। কিন্তু দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষ এ ধরণের লোক পেলেই এখন ধরছে।

“তারা ৫-৬ লাখ টাকা নিয়ে ভালো কোম্পানিতে কাজ দেয়ার লোভ দেখিয়ে লোক আনে। অথচ এসে কাজ পায় না বা নিম্নমানের কাজ করে। কয়দিন পর পুলিশ ধরে তাদের দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।”

সোহরাব হোসেন বলছেন, ইমিগ্রেশন পুলিশ এখন খুব কড়া অবস্থানে আছে। ফ্রি ভিসার শ্রমিকদের হোটেলের রুমে গিয়ে তল্লাশি করেও ধরে আনছে।

দালালদের পাশাপাশি মালদ্বীপে থাকা স্বজনদের কারণেও অনেকে প্রতারিত হচ্ছেন।

হুলহুমালের প্রবাসী বাংলাদেশি আকতার হাবিবের ভাষ্য, অনেক বাংলাদেশি চান তার খালাতো ভাই, চাচাতো ভাইয়ের মত আত্নীয় মালদ্বীপে আসুক।

“তারা তখন ফ্রি ভিসায় লোক আনে। কিছুদিন হয়তো ভালো থাকে। তখন সেও আরও লোক আনতে চায়।”

তার আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে বৈধ প্রবাসীরাও বিপদে পড়তে পারেন।

আকতার বলেন, “আপনি যখন রেড লিস্টে থাকবেন, তখন চুন থেকে পান খসলেই ঝামেলায় পড়বেন। এটা কারও জন্যই ভাল হবে না।”

বিদেশে যেতে প্রতারণা থেকে বাঁচার উপায়

মালের বাসিন্দা আব্দুল করিমের পরামর্শ- শুধু মালদ্বীপ না, যে কোন দেশে যাওয়ার আগেই কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত।

তাহলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে প্রতারিত হতে হবে না।

আব্দুল করিম বলেন, “আপনি লাখ লাখ টাকা খরচ করবেন, তাহলে যেনতেনভাবে আসবেন কেন? লুকিয়ে-পালিয়ে থাকার চেয়ে দেশে কিছু করাই ভালো।”

তার পরামর্শ, বিদেশে যেতে হলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

১। যিনি নিচ্ছেন, তিনি বিশ্বস্ত কিনা।

২। যেখানে যাবেন, সেখানে কর্মপরিবেশ ভালো কিনা।

৩। বিদেশে কাজ করার জন্য ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট, নিয়োগপত্রের মত কাগজপত্র ঠিক কিনা।

৪। চুক্তিপত্রে যেসব শর্ত আছে, তা ঠিক কিনা।

৫। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বেতন, সুযোগ সুবিধা ঠিক আচে কিনা।

৬। যে কাজে যাবেন, সে কাজের জন্য শারিরীক-মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা।

এসব বিষয় বিবেচনা করে বিদেশের কথা চিন্তা করলেই প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব বলে মনে করেন আব্দুল করিম।