আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক
ক্যারিবিয়ান সাগরে গত দুই মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ, বোমারু বিমান, ড্রোন ও নৌবাহিনী ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। লক্ষ্য- ভেনিজুয়েলা।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি, এসব কিছু করা হচ্ছে মাদক চোরাচালানকারীদের নির্মূল করতে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মাদক অজুহাত মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র মূলত চাইছে ভেনিজুয়েলায় নিকোলাস মাদুরোর সরকারের পতন ঘটাতে।
মার্কিনীদের বিরুদ্ধে অন্য দেশে সরকার পতনে তৎপরতা চালানোর অভিযোগ বহু পুরনো। এই তালিকায় সবশেষ নাম এলো ভেনিজুয়েলার।
যা হচ্ছে ভেনিজুয়েলাকে ঘিরে
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ক্যারিবিয়ান সাগর এলাকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি দেখিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে দীর্ঘপাল্লার বি-৫২ বোমারু বিমান উড়িয়ে ভেনিজুয়েলা উপকূলের কাছে ‘বোমা হামলার মহড়া’ চালিয়েছে। একইসঙ্গে গুপ্তচর সংস্থা সিআইএকে ভেনিজুয়েলায় পাঠানোর অনুমতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
যুক্তরাষ্ট্র দাবি করছে, মাদকবিরোধী ‘যুদ্ধের’ অংশ হিসেবে এসব তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
কিন্তু এর পক্ষে তেমন তথ্য-প্রমাণ হাজির করতে পারেনি মার্কিনীরা। বরং হামলার ধরন দেখে বিশেষজ্ঞরা বলছেন- এটি আসলে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি রাজনৈতিক বার্তা, যার মূল লক্ষ্য নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশ্যে মাদুরোকে ‘স্বৈরাচারী’ আখ্যা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে মাদুরোর বিরুদ্ধে তথ্য দিলে ৫০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
যদিও এত বড় অঙ্কের পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েও মাদুরোর অন্দরমহলের খবর বের করতে পারেনি ওয়াশিংটন।
চ্যাথাম হাউসের লাতিন আমেরিকা বিশ্লেষক ড. ক্রিস্টোফার সাবাতিনি মনে করেন, সরাসরি আক্রমণ না করে যুক্তরাষ্ট্র বরং ভয়ের প্রদর্শনী চালাচ্ছে।
“যুক্তরাষ্ট্র চায় মাদুরোর সেনা ও উপদেষ্টারা আতঙ্কে নিজে থেকেই তাদের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাক এবং ক্ষমতার পরিবর্তন হোক”, বলেন তিনি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওয়াশিংটন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, সামরিক চাপ ও মানসিক যুদ্ধের সমন্বয়ে একটি রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে, যাতে ভেনিজুয়েলায় সামরিক বিদ্রোহের পথ তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাদকবিরোধী অভিযান’- বাস্তবে কী ঘটছে?
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা ক্যারিবিয়ান সাগরে ভেনিজুয়েলার ছোট জাহাজগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করছে। কারণ, এসব জাহাজ মাদক দ্রব্য চোরাচালান ও সন্ত্রাসবাদে জড়িত।
কিন্তু এসব অভিযোগের কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি মারা যাওয়াদের কেউ মাদকের সঙ্গে জড়িত, সেই পরিচয়ও প্রকাশ করতে পারেনি ওয়াশিংটন।
যে ফেন্টানিলকে যুক্তরাষ্ট্র মূল অভিযানের কারণ বলছে- সেটি মূলত তাদের প্রতিবেশী দেশ মেক্সিকোতে উৎপাদন হয়, দক্ষিণ আমেরিকায় নয়।
একইভাবে কোকেন উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র হলো কলম্বিয়া, পেরু ও বলিভিয়া; ভেনিজুয়েলা নয়। ২০২৫ সালের মার্কিন প্রতিবেদনেই দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে জব্দ হওয়া ৮৪ শতাংশ কোকেনের উৎস কলম্বিয়া, তালিকায় ভেনিজুয়েলার নামই নেই।
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক প্রদর্শনী চালাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে মাদককে রাজনৈতিক ঢাল করতে চাইছেন, যা মাদুরো সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর কৌশল।
মার্কিন সামরিক শক্তির প্রদর্শনী
বিবিসির স্যাটেলাইট ছবি অনুযায়ী, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে কমপক্ষে ১০টি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ অবস্থান করছে। এর মধ্যে রয়েছে গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, অ্যামফিবিয়াস অ্যাসল্ট শিপ এবং রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর পূর্ব উপকূলের কাছে অবস্থান করা এমভি ওশিয়ান ট্রেডারে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও ছোট বোট বহন করা যায়।
এছাড়া পুয়ের্তো রিকোর ঘাঁটিতে এফ-৩৫ স্টিলথ জেট ও এমকিউ-৯ রিয়েপার ড্রোন মোতায়েন করা হয়েছে। এই ড্রোনগুলোই আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লিবিয়ায় মার্কিন হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল।
অক্টোবরে আরও তিনটি বি-৫২ বোমারু বিমান ভেনিজুয়েলার আকাশসীমার কাছাকাছি মহড়া চালিয়েছে, যা ‘বোমার অ্যাটাক ডেমোনস্ট্রেশন’ নামে পরিচিত।
সিআইএ’র ভূমিকা নিয়ে নতুন বিতর্ক
বিবিসি, আল জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী- ট্রাম্প প্রশাসন সিআইএকে ভেনিজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছে।
পরে সাংবাদিকরা সরাসরিই ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, সিআইএকে কি মাদুরোকে টার্গেট করতে পারে? মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন এড়িয়ে কেবল বলেন, “এর উত্তর দেওয়া বোকামি হবে।”
সিআইএ বিশ্লেষক নেড প্রাইস মনে করেন- এ ধরণের অভিযানে তথ্যের খেল দেখানো, ধ্বংসাত্মক তৎপরতা কিংবা বিরোধী দলগুলোকে অর্থায়ন করার মত কার্যক্রম হাতে নেওয়া হতে পারে।
“এমনকি তা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পর্যায়েও যেতে পারে”, বলেন তিনি।
অতীতে লাতিন আমেরিকায় সিআইএ’র ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক থাকায় অনেক দেশ আশঙ্কা করছে- যুক্তরাষ্ট্র আবারও ইতিহাসের পুরোনো পথেই হাঁটছে।
লড়তে চান মাদুরো
মার্কিন চোখ রাঙানির মধ্যে পিছু না হটে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতাকে ভেনিজুয়েলার সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র আমাদের পতন চায়, কিন্তু আমরা প্রতিরোধ করব।”
মাদুরো সরকার ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনা মোতায়েন বাড়িয়েছে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি অধিবেশন ডাকার আহ্বান জানিয়েছে।
এছাড়া ক্যারিকম ও ইউনাসুর মত আঞ্চলিক সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, এই উত্তেজনা ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও, ভেনিজুয়েলার জাহাজ লক্ষ্য করে সাম্প্রতিক মার্কিন হামলাকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
ভেনিজুয়েলায় হামলা চালাতে পারে যুক্তরাষ্ট্র?
যুক্তরাষ্ট্র ভেনিজুয়েলায় সরাসরি হামলা চালিয়ে বসে কিনা- তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
তবে চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর মাইকেল আলবার্টাস মনে করেন, ট্রাম্প ভেনিজুয়েলায় পূর্ণাঙ্গ আক্রমণ করবেন না।
“এটি এক ধরনের প্রদর্শন কৌশল- যাতে মাদুরো প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী ভয় পায় এবং তাদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়।”
অর্থাৎ এই অভিযানকে আধুনিক শীতল যুদ্ধের নতুন ধরন হিসেবে দেখা যেতে পারে। যার মাধ্যমে ট্রাম্প সরাসরি আক্রমণে না গিয়ে মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করে ক্ষমতায় রদবদল করতে চাচ্ছেন।
