আয়েশা মির্জা, করাচি
পাকিস্তানের করাচির কেমারি এলাকার সরু গলি আর সমুদ্রবন্দরের ধারে ৩৬ বছর বয়সী ফাতিমার জীবন আটকে আছে। ছোটবেলা থেকেই তার সঙ্গী এই বন্দরনগরীর পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর নিয়তি।
জেলে পরিবারে জন্ম নেওয়া ফাতিমা পরে আরেকজন জেলের সঙ্গে সংসার গড়েন। একসময় পুরো এলাকা ছিল মৎস্যজীবী পরিবারে ভরা, কিন্তু এখন আর তেমন নেই। যারা এ পেশায় টিকে আছেন, তাদের মধ্যে খুব কমই বাঙালি।
মাছের পরিমাণ দিন দিন কমে আসা, সমুদ্রে নানা ধরনের শিল্পকারখানার চাপ এবং সরকারি বিধিনিষেধ—এসব কারণে শুধু মাছ ধরে আর জীবন চলে না।
ফাতিমার স্বামী মাছ ধরেই সংসার চালাতেন, কিন্তু উপার্জন যথেষ্ট ছিল না। কয়েক বছর আগে স্বামীর এক গ্রাহক দয়া করে ফাতিমাকে একটি সেলাই মেশিন কিনে দেন। তখন থেকে তিনি সেলাইয়ের কাজ করছেন। তবে এই কাজও নিয়মিত নয়, ফলে সংসারে সবসময় অভাব লেগেই আছে।
শুধু ফাতিমা নন, পাকিস্তানের ৩০ লাখের বেশি বাঙালির জীবন দেশটিতে বিদ্যমান বৈষম্যের প্রতীক হয়ে আছে।
পাকিস্তানে বাঙালিদের আইনি সংকট
পাকিস্তানের বাঙালিদের দুর্দশার শিকড় লুকিয়ে আছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও পরবর্তী ইতিহাসে। শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে রাষ্ট্র গঠিত হলেও রাজনৈতিক, ভাষাগত ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমেই বেড়ে যায়। এর পরিণতিতে ১৯৭১ সালে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ।
যুদ্ধের পর পাকিস্তানে থেকে যাওয়া কিংবা আগে থেকে সেদেশে যাওয়া লাখ লাখ বাঙালি পড়েন নাগরিকত্ব সংকটে। প্রথমদিকে অনেককে পরিচয়পত্র দেওয়া হলেও পরে নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়ায় তাদের কার্ড বাতিল করা হয়।
বিশেষ করে ডিজিটাল পরিচয়পত্র চালু হওয়ার পর অনেকের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্লক হয়ে যায়। এর ফলে এখনো কয়েক মিলিয়ন বাঙালি পাকিস্তানে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় বসবাস করছে।
করাচিতেই প্রায় ৩০ লাখ বাঙালি বাস করে। তারা ছড়িয়ে আছে ১২৬টি কলোনিতে। সবচেয়ে বড় বসতি হলো মচ্ছর কলোনি- একটি বিশাল বস্তি, যেখানে প্রায় আট লাখ মানুষ থাকেন। এদের ৬০ শতাংশই বাঙালি বা বার্মিজ বংশোদ্ভূত। পরিচয়পত্র না থাকায় তারা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, চাকরি, এমনকি বিদ্যুৎ-গ্যাসের মতো মৌলিক সেবাও পান না।
নাগরিকত্বহীনতার কারণে বৈষম্য
এই নাগরিকত্বহীনতার ফলে পাকিস্তানের বাঙালিরা নানা বৈষম্যের শিকার। করাচির গুলশান-ই-ইকবাল এলাকায় বার্গার ভ্যান চালান ৪০ বছর বয়সী আবদুর রহমান। ১৮ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করলেও তার জীবনযাত্রা উন্নত হয়নি। প্রতিদিনই পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের হয়রানি তাকে ভোগায়। অনেক সময় আয় করা টাকার চেয়ে ঘুষের পরিমাণ বেশি দিতে হয়।
তিনি বলেন, “আমি বাঙালি বলে পুলিশ প্রায়ই ভ্যান তুলে নিয়ে যায়। পাশে থাকা পাঞ্জাবি ভ্যানওয়ালাদের সঙ্গে এমনটা হয় না।”
এমন অভিজ্ঞতা শুধু তার নয়। হাজারো বাঙালি পরিবার প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্নভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
অনিশ্চিত জীবনে মেহবুবের গল্প
৪৫ বছর বয়সী মেহবুব করাচিতে প্রায় তিন দশক ধরে বাস করছেন। গুলশান এলাকায় ছোট্ট একটি পান-সিগারেটের দোকান চালান তিনি। দোকান থেকে সামান্য আয় করে নিজের আর ভাইয়ের সংসার চালাতে হয়। কিন্তু পরিচয়পত্র না থাকায় তাদের জীবন সবসময় অনিশ্চিত।
তিনি বলেন, “আমরা প্রায়ই বাসা পাল্টাতে বাধ্য হই। বাড়িওয়ালারা বলে, পরিবার আনতে হবে নইলে বাসা ছাড়তে হবে। কিন্তু পরিবার আনব কীভাবে, আমাদের তো কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই।”
বিদ্যুৎ ঘন ঘন চলে যায়, পানির সরবরাহ অনিয়মিত- এমন দুর্বিষহ পরিবেশেই কাটে তাদের প্রতিদিন। কয়েক বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মেহবুবের এক ভাই মারা গেছেন। এখন বাকি দুই ভাই মিলে দোকান চালান। এর মধ্যেই তাদের ওপর চাপ বাড়ছে পরিবারের খরচ চালানো, ভাড়া দেওয়া আর টিকে থাকার সংগ্রাম।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে অগ্রগতি, কিন্তু সমাধান অধরা
দীর্ঘদিন সম্পর্ক স্থবির থাকার পর ২০২৪ সালে ঢাকায় ক্ষমতার রদবদল হলে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে আলোচনার সূচনা হয়। দুই দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বৈঠক ও যাওয়া-আসার মধ্যে রয়েছে।
তবে এসব রাজনৈতিক অগ্রগতির কোনো প্রভাব পড়েনি পাকিস্তানে বসবাসরত বাঙালিদের জীবনে। নাগরিকত্ব বা পরিচয়পত্র সমস্যার সমাধান হয়নি।
করাচিভিত্তিক ইমকান ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের পরিচালক তাহেরা হাসান বলেন, “সম্পর্ক উন্নত হলেও বাঙালিদের দুর্দশা কমেনি। প্রশাসনিক জটিলতা এখনো আগের মতোই।”
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনিশ্চয়তা
ফাতিমা চান তার ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করে ভালো ভবিষ্যৎ গড়ুক। তিনি স্বপ্ন দেখেন সন্তানরা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে। কিন্তু পরিচয়পত্র না থাকায় নিয়মিত স্কুলে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় স্কুল থেকেও তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ফাতিমা বলেন, “আমি চাই আমার সন্তানরা যেন সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো কাগজপত্র নেই। তাই ভবিষ্যৎও অন্ধকার।”
পাকিস্তানে বাঙালিদের ভবিষ্যৎ
পাকিস্তানে জন্ম নেওয়া ও বেড়ে ওঠা বাঙালিদের কাছে সে দেশটিই তাদের মাতৃভূমি। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তারা বহিরাগত। কেউ কেউ কষ্ট করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন, কিন্তু তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। আর্থিক সংকট, কাগজপত্রের ঝামেলা এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের পিছু ছাড়ছে না।
বছরের পর বছর ধরে এভাবে রাষ্ট্রহীন জীবন কাটিয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ বাঙালি। তারা আশা করছেন- একদিন হয়তো পাকিস্তান তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। আর তখন হয়তো তাদের সন্তানরা নতুন জীবনের সুযোগ পাবে।
পাকিস্তানে বাঙালিদের দুর্দশা শুধু অভাব-অনটনের গল্প নয়, এটি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও পরিচয়হীন জীবনের দীর্ঘ যন্ত্রণা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনিশ্চয়তা বয়ে বেড়ানো এই জনগোষ্ঠী আজও অপেক্ষায় আছে- একটি বৈধ পরিচয়, একটি নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য।
