ইতিহাসের সাগর আবারও ইতিহাসের পাতায়

আবু তাহের

বাংলাদেশের অলিম্পিয়ান সাঁতারু মাহফিজুর রহমান সাগর। পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান টিংকু এবং মসকুরা খাতুন নিলুর সন্তান সাগর আগেই ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন। তবে তার প্রথম ইতিহাসের পাতায় নাম লেখানো একটু ভিন্ন কারণে। এ ইতিহাস বাংলাদেশের সর্বসাধারণ মানুষের জন্য নয়, তার নিজের জন্য যা মানুষের না জানলেও চলতো। সেটা হল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম আবর্তনে ইতিহাস বিভাগে ভর্তির হয়ে ইতিহাসে নাম লেখানো। সেখান থেকেই শুরু, এরপর একেরপর এক গড়েছেন অনেকগুলো ইতিহাস। অবশ্য সেই শুরুটা হয়েছে ছোটবেলা থেকেই।

মাহফিজুর রহমান সাগরের ইতিহাসের পাতায় উঠা শুরু অলিম্পিক দিয়ে। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক দিয়ে প্রথমবার ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ এ অংশগ্রহণের সুযোপ পান দেশের পেশাদার সাঁতারু। লন্ডনে হওয়া গ্রীষ্মকালীন ওই অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের পতাকা বহন করেছিলেন তিনি। পরেরবার ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে অংশগ্রহণের সুযোগও আসে সাগরের কাছে। সেবারও অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করে করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম পুরুষ সাঁতারু হিসেবে পরপর দুবার অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করা একমাত্র অ্যাথলেট তিনি, সেখানেই গড়েন ইতিহাস।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসর অলিম্পিকে ইতিহাস তৈরি করেও থেকে থাকেননি সাগর। এর মাঝে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাঠ শেষ করেছেন। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নাবিক হিসেবে কাজ করে পরে অবসর গ্রহণ করেছেন ২০২৩ সালে। কাজ করেছেন বাংলাদেশ সাঁতার ফেডারেশনের সহকারী কোচ হিসেবে। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ঢাকাতে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তবে কর্ম ব্যস্ততাময় জীবনেও থেমে থাকেনি তার ইতিহাস তৈরির নেশা। নতুন ইতিহাস তৈরিতে পাড়ি দিয়েছেন আটলান্টিক মহাসাগরের বাহু ইংলিশ চ্যানেল যা বিভক্ত করেছে ইংল্যান্ড ও ফান্সকে।

ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে যাওয়ার আগে সাগর বলেছিলেন, ‘মূলত ইংলিশ চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ধরা হয় ৩৪ কিলোমিটার। কিন্তু কেউ কখনও সরাসরি ৩৪ কি.মি সাঁতরাতে পারে না। কারণ এখানে স্রোত থাকে, ঢেউ থাকে, তো এটা প্রায় ৪০ কিলোমিটারের কম বেশি হয়ে থাকে। কখনও কখনও এটা ৫০-৬০ কিলোমিটারও হয়ে যায়। সমুদ্রের জন্য এর দৈঘ্য ঠিক করা যায় না, কিন্তু নির্ধারিত যেটা ধরা হয় তা ৩৪ কি. মি.। ইংলিশ চ্যানেলকে আসলে ধরা হয় মাউন্ট এভারেস্ট। সুতরাং ইংলিশ চ্যানেলে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। অ্যাডভেঞ্চার সাঁতার বা খোলা পানির সাঁতার দেয়া প্রত্যেকটা দেশ বা উন্নত দেশগুলো এ চ্যানেলের সাঁতারকে অনেক মর্যাদা দেয়। সুতরাং এটা মর্যাদাপূর্ণ একটি প্রতিযোগিতা যা ব্যক্তি উদ্যোগে করে থাকে। এর বিশেষত্ব যারা সাঁতারের সাথে যুক্ত তারা খুব ভালোভাবেই জানে। আমার ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন ছিল এই চ্যানেল সাঁতরে যে কোনো মূল্যে পাড়ি দিব।’

সাগরের দেশীয় প্রতিযোগিতায় সাফল্যের হারও বেশ ইর্ষানীয়। তিনি ২০০১ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) ভর্তি হয়েছিলেন। অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি অধ্যয়নকালে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার ১৫০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। ২০০৮ সালে বিকেএসপি থেকে জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সেরা সাঁতারুর খেতাব অর্জন করেন। ২০০৮ সালে ব্যক্তিগত পাঁচটি ইভেন্টের যৌথ রিলেতে তিনটি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ২০১০ সালে সাফ গেমসে তিনটি ইভেন্টে ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইলে ব্রোঞ্জ, ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে সিলভার এবং ৪০০*১০০ মিটার রিলেতে রৌপ্যপদক পান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সাঁতারে বিশ্ববিদ্যালয়কে চ্যাম্পিয়ন করেছেন সাগর। ২০১৭ সালে পঞ্চম বিশ্ববিদ্যালয় গেমস সাঁতারে রেকর্ড গড়েছিলেন। বাংলাদেশ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় গেমসের ১২টি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে ১২টিতে স্বর্ণ জিতেছিলেন।

পেছনের এসব সাফল্য, তিন মাসের পরিশ্রম, সাধনা ও প্রচেষ্টা সাগরকে সাহস জুগিয়েছে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে। এ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে সাগর শুনিয়েছেন তার সাফল্যের কথা। বলেছেন- ‘ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা চমৎকার, অন্যরকম অনুভূতি কাজ করেছে আমার মধ্যে। আমার সাঁতার শুরু হয়েছিল রাত ২টা ৪৩ মিনিটে। ইংল্যান্ডের কেন্টের স্যামফায়ার হো সমুদ্র সৈকত থেকে ২৯ জুলাই সাঁতার শুরু করি রাত ২টা ৪৩ মিনিটে। আমার এ যাত্রা শেষ হয় ফ্রান্সের কেপ গ্রিস-নেজ সমুদ্র সৈকতে ২৯ জুলাই দুপুর ২টা ৫৩ মিনিটে। এ সময় আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল যেভাবেই হোক আমাকে এ চ্যানেল শেষ করতে হবে। সাঁতারের মাঝে নৌকায় করে বিশ্রাম নিয়েছি। একবার রিলেতে নামার পর একঘণ্টা করে সাঁতার কাটতে হয়। আমাদের মূল সাঁতার হওয়ার কথা ছিল ১৭-২৩ জুলাইয়ের মধ্যে। তবে সাগরের পরিবেশ ভালো না থাকায় পিছিয়ে ২৯ তারিখ চলে যায়। শুরুতে সী সিকনেসের কারণে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, তবে সাঁতার শেষ করতে পারব না এমনটা মাথায় আসেনি। শুধু মনে হচ্ছিল ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি কি না? সি সিকনেসের কারণে খাওয়া দাওয়ার পরিবেশ থাকে না, এজন্য কেউ খাওয়ার কথা চিন্তা করে না। তবে এ সময় শুধুমাত্র ইলেকট্রোলাইট ড্রিংসগুলোই নিয়েছি, অন্য কিছু নয়। এরপর ১২ ঘণ্টা ১০ মিনিট সাঁতরে চ্যালেঞ্জ শেষ করে মনে হয়েছে, এত দিনের পরিশ্রম সফল হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে আমি সফলতা আনতে পেরেছি।’

‘অবশ্য এ সাঁতার শুরুর আগে-পরে বা মাঝে কিছু প্রতিবন্ধকতাও ছিল যা কিছুটা শঙ্কা তৈরি করেছিল। রাত আড়াইটার পর সাঁতার শুরু করা অন্যরকম অভিজ্ঞতা, নতুনও বটে। পানিতে নামার পর অনুভব করলাম প্রচণ্ড ঠান্ডা, তার উপর ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়েছে। সাঁতার শুরু করার আগে বমি করছিলাম এবং তার জন্য সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। শুরু করার সময় অভিজ্ঞতা ছিল খুবই ভয়াবহ। তার উপর পানির মধ্যে জেলিফিস ছিল, লবণাক্ত পানি এবং আমাকে কত ঘণ্টা সাঁতরাতে হবে সেটা জানা ছিল না। এছাড়া সাগর কেন্দ্রিক অসুস্থ্যতা এবং আরও অনেক ধরণের সমস্যা তো ছিলই। অন্য কারও যে কোনো সময় সাঁতার ছেড়ে দেয়ার শঙ্কাও ছিল। তবে কোনো শঙ্কায়ই আমাদের উপর জেকে বসতে পারেনি।’

সাগররা যে ইতিহাস এখন গড়লেন বাংলাদেশের জন্য তার শুরুটা কিংবদিন্ত সাঁতারু ব্রজেন দাসের হাত ধরে ১৯৫৮ সালে। তিনি শুধু বাঙালি নন, দক্ষিণ এশিয়দের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়া প্রথম সাঁতারুও ব্রজেন দাস। তার দেখানো পথে ১৯৬৫ সালে আব্দুল মালেক ও ১৯৮৮ সালে মোশাররফ হোসেন পাড়ি দেন ইংলিশ চ্যানেল। এই ব্রজেন-সাগরদের ইতিহাস লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বের দরবারে উঁচিয়ে ধরার ইতিহাস। বাংলাদেশের জন্য এমন ইতিহাস বারবার ফিরে আসুক সাগর-হিমেলদের হাত ধরে। ৩৭ বছর পর ইতিহাস তৈরি করা সাঁতারুদের জন্য আমরা গর্বিত।