রাকসুতে ভোট পড়েছে ৬৯.৮৩%, সারাদিন যা যা হলো

সাজিদুর রহমান সাজিদ, রাবি প্রতিনিধি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। সকাল ৯টায় নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হয় ভোট গ্রহণ, চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। পরে বিকেল ৫টার ভেতর বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে ব্যালট বাক্স নিয়ে আসা হয় এবং গণনা করার জন্য প্রস্তত করা হয়।

এবারের নির্বাচনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি এবং উৎসবমুখর পরিবেশে ৬৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বাংলা ইনসাইট টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা শিক্ষার্থীদের নির্বাচন। তাদের ভাষ্যমতে একটি অসাধারন নির্বাচন হয়েছে। সকল শিক্ষার্থী উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিয়েছে।

“নির্বাচন পর্যবেক্ষক কমিটি আমাদের জানিয়েছে, এই নির্বাচন ছিলো তাদের দেখা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ নির্বাচন।”

নির্বাচন কমিশনের তথ্য মতে, এবারের নির্বাচনে মোট ভোটার ২৮ হাজার ৯০১ জন। মোট ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ২০ হাজার ১৮৭ জন, অর্থাৎ ৬৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ বোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

সবচেয়ে বেশি ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছে সৈয়দ আমীর আলী হলে এবং সবচেয়ে কম ৫৯ দশমিক ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে রোকেয়া হলে।

সরেজমিনে দেখা জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অ্যাকাডেমিক ভবনের ১৭টি কেন্দ্রে ভোট দেন শিক্ষার্থীরা। ভোটের দিনে সকাল থেকেই ফটকগুলোতে অবস্থান নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এবং স্কাউট সদস্যরা।

সকাল সাড়ে ৭টায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ব্যালট পেপার ও বাক্সসহ প্রয়োজনীয় সকল কিছু পাঠানো হয়। বেলা ৯টা বাজতেই কেন্দ্রের সামনে শিক্ষার্থীদের লম্বা লাইন হয়। পরে বেলা গড়াতে উপস্থিতি আরও বাড়তে থাকে। ক্যাম্পাসজুড়ে দল বেধে আসতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তাদের সকলের চোখেমুখে দেখা যায় দীর্ঘ অচলায়তনের পরে আয়োজিত রাকসু নিয়ে উৎসবের আমেজ।

নির্বাচনে বড় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও কিছু বিষয়ে শিক্ষার্থী ও প্রার্থীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ আসে।

কাজে দেয়নি অমোচনীয় কালি

নির্বাচনে জালিয়াতি এড়াতে নেওয়া হয় তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তার মাঝে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভোটারদের হতে অমোচনীয় কালির দাগ।

তবে ভোটের কার্যক্রম শুরু হতেই অমোচনীয় কালি উঠে যাওয়ার অভিযোগ আসতে থাকে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোটাররা ভোট দিয়ে বের হয়ে হাতের কালো দাগে ঘষা দিতেই সেটি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে ডিনস কমপ্লেক্স কেন্দ্র, শহিদুল্লাহ কেন্দ্র, চতুর্থ বিজ্ঞান ভবন কেন্দ্রসহ সকল কেন্দ্রে।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে প্রার্থী ও প্যানেলগুলো। দিনের শুরুতে তারা অভিযোগ জানালেও কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি।

ভোটার আসার আগেই স্বাক্ষরিত শতাধিক ব্যালট

এ দিন বেলা গড়াতেই কেন্দ্রে ভিড় বাড়তে থাকে। তবে বেলা ৩টার দিকে শহীদুল্লাহ অ্যাকাডেমিক ভবনের ১৫০ গ্যালারিতে শহীদ জিয়াউর রহমান হল কেন্দ্রে ভোটার আসার আগেই প্রায় শতাধিক ব্যালট পেপারে স্বাক্ষর করেছেন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মশিউর রহমান।

ওই কেন্দ্রের পোলিং এজেন্টরা দাবি করেন ভোটে কারচুপি করার জন্যই এ স্বাক্ষর করা হয়েছে।

ভোট কেন্দ্রটিতে দেখা যায়, কেন্দ্রের দায়িত্বরত সহকারি প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ভোটার আসার আগেই শতাধিক ব্যালট পোপার স্বাক্ষর করে রেখেছেন।

এ বিষয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্র্রে ভোটারের ভিড় বেশি থাকায় তিনি আগে থেকে স্বাক্ষর করে রেখেছেন। কোনো কারচুপির সুযোগ নেই।

ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত পোলিং এজেন্ট মহিউদ্দিন আহমেদ সীমান্ত বাংলা ইনসাইট টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেন্দ্রে হঠাৎ আমি দেখতে পাই স্যার তার কাছে গেলেই তিনি পেপার দিয়ে দেন। আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি তিনি ভোটার আসার আগেই শতাধিক পেপার স্বাক্ষর করে রেখেছেন।

“তিনি তার পছন্দের ভোটার আসলেই একের অধিক ব্যালট পেপার দিবেন, এই উদ্দেশে তিনি এটি করেছেন।”

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রের দায়িত্বরত প্রিজাইডিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, “কেন্দ্রে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে। কর্মকর্তার এই কাজটি ঠিক হয়নি।”

ক্যাম্পাস সংলগ্ন এলাকায় জামায়াত-বিএনপির অবস্থান

এ দিকে নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বিনোদপুর, চারুকলা, মেহেরচন্ডী, কাজলাসহ একাধিক জায়গায় অবস্থান নিতে দেখা গেছে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ও তাদের অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীদের।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর ফটকের বাম পাশে ক্যাম্পাসের প্রাচীরের পাশে সামিয়ানা টাঙিয়ে অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় বিএনপি, যুব ও ছাত্রদলের নেতাকমীরা।

এ ছাড়াও বিএনপি ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনের মতি শাহ’র মাজারের পাশে অবস্থান নিয়েছে।

অন্যদিকে স্থানীয় জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়েছেন বিনোদপুর বাজারের ইসলামি ব্যাংকের সামনে। তাদের আরেকটি দল অবস্থান নিয়েছে কাজলা ফটকের বিপরীত পাশে।

এ ছাড়াও তারা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে বরই বাগানে রান্নার আয়োজনও করেছেন।

সকাল থেকেই উভয় দলের নেতাদেরই ক্যাম্পাসের আশেপাশের সড়কে মোটরসাইকেল মহড়া দিতে দেখা গেছে।

তাদের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর শিবিরের সাধারণ সম্পাদক ইমরান নাজির বাংলা ইনসাইট টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘ বছর পরে রাকসু নির্বাচন হচ্ছে। এলাকার উৎসুক জনতা আগ্রহ থেকে তারা এখানে এসেছেন। আমাদের এর বাইরে কোনো উদ্দেশ্য নেই।”

বিনোদপুরে অবস্থান নেওয়া মহানগর যুবদল নেতা আরিফুজ্জামান বাংলা ইনসাইট টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত বছর পরে রাকসু নির্বাচন হচ্ছে। নির্বাচনের আগ্রহ থেকেই আমরা এখানে এসেছি। ওই পাশে খেয়াল করলেই দেখবেন জামায়াত ও শিবিরের নেতারাও অবস্থান নিয়েছেন।”

শিবিরের বিরুদ্ধে পরিবেশ ‘অস্থিতিশীল’ করার অভিযোগ ছাত্রদলের

এ দিকে নির্বাচনে শিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’ এর বিরুদ্ধে বহিরাগত ঢুকিয়ে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিসহ একাধিক অভিযোগ তুলেছে ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেল’।

দুপুর সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্যানেলের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম প্যানেলের ভিপি প্রার্থী শেখ নূর উদ্দিন আবীর বলেন, “আমরা আশা করেছিলাম দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া রাকসু নির্বাচনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ পাবো।

“সকালে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলেও, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে।”

অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার অভিযোগ তুলে আবীর বলেন, “সকালে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ ছিল, যা আমরা গণমাধ্যমকেও জানিয়েছি। কিন্তু পরক্ষণেই আপনারা দেখেছেন ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বিনোদপুর, স্টেশন বাজার, চারুকলা গেট দিয়ে।

“সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট নামক প্যানেল বহিরাগতের তাদের প্যানেলের টি-শার্ট পড়িয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার পায়তারা করে।”

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বেতার মাঠে শিবিরের ক্যাডার বাহিনী কয়েক হাজার অস্ত্র মজুদ রেখেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ভোটপ্রদানে নিরুৎসাহিত করতে সনাতনী ভোটারদের শিবির হুমকি দিয়েছে অভিযোগ তুলে এই ভিপি প্রার্থী বলেন, “তাদের ভয় ছিলো সনাতনী ধর্মের ভাইদের ভোট তারা পাবে না। তাই তারা (শিবির সমর্থিত জোট) গতকাল রাত থেকে বিভিন্ন মেসে মেসে এবং হলে গিয়ে সনাতনী ভাইদের হুমকি দিয়ে ভোট প্রদানে নিরুৎসাহিত করে এসেছে।

“সনাতনীদের সরাসরি হুমকি দিয়ে বলা হয়েছে, যদি কেউ ভোট দিতে আসে, তবে তাদের একাডেমিক জীবন হুমকিতে পড়বে।”

এ ছাড়াও আবীর ভুয়া সাংবাদিক সেজে সাবেক শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ, ছাত্রী সংস্থার বিরুদ্ধে কৃত্রিম জটলা তৈরি, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের শিবিরের হয়ে প্রচারণার অভিযোগ করেন।

ক্যাম্পাসে বহিরাগত ঢোকানোর অভিযোগ ছাত্রদলের বিরুদ্ধে

ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশসহ নির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তোলে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ আনেন তারা।

ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের জিএস ফজলে রাব্বী ফাহিম বলেন, “নির্বাচনে নানা অনিয়ম ধরা পড়েছে। অমোচনীয় কালি ব্যবহার হয়নি। এ ছাড়া সকালে সিরাজী ভবনে চিরকুট নিয়ে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। একাধিক ভোটকেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটেছে। কিন্ত নির্বাচন কমিশন গতকাল বলেছিলেন চিরকুট নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন।”

অভিযোগ করে তিনি আরো বলেন, “ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ও আধিপত্য বিরোধী প্যানেল ভোটকেন্দ্রের একশ মিটারের মধ্যে প্রচার করছে। তারা কয়েকটি স্থানে বুথও স্থাপন করেছে।”

ক্যাম্পাসে বহিরাগত প্রবেশ করছে উল্লেখ করে ফাহিম বলেন, “ক্যাম্পাসে ছাত্রদল-যুবদল প্রবেশ করছে। ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ক্যাম্পাসে বসে গুজব ছড়াচ্ছে, অথচ তিনি ক্যাম্পাসের কেউ নন। ছাত্রদল সভাপতিও এরকম একটি পোস্ট শেয়ার দিয়েছে।”

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে গুজব ছাড়ানো দাবি

নির্বাচনকে ঘিরে ক্যাম্পাস সংলগ্ন বরই বাগান এলাকায় একটি ভিডিও প্রকাশ করে অভিযোগ করা হয়- সেখানে অস্ত্র বিনিময় করা হচ্ছে, এমন দাবি করেন রাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী।

তবে তার অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ।

মহানগর পুলিশের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “এরকম একটি প্রকাশ্য স্থানে পুলিশ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং মিডিয়া কর্মীদের নাকের ডগায় অস্ত্র বিতরণ করা সম্ভব নয়।

“কোন একটি মহল উৎসুক লোকজনের আড্ডা দেয়া ও খাওয়ার বিষয়টি দূর থেকে ধারন করে অস্ত্র বিতরণের নামে গুজব ছড়িয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ও আতংক ছড়ানোর চেষ্টা করছে।”

এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচন চলাকালীন এক গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলার সময় বোমা ফাটানোর একটি দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওটিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা বলে জানিয়েছে পুলিশ।

তাদের বিবৃতিতে বলা হয়, ভিডিওটি রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দৃষ্টিগোচর হয়। পরবর্তীতে ভিডিওটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ফ্যাক্ট-চেক করে দেখা যায়, দৃশ্যটি সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা তৈরি, যা ভুয়া।