ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময় চলছে। রয়্যাল এয়ারফোর্সে সৈনিকের চাকরির সুবাদে এক বৈমানিকের মুখোমুখি বাংলার লুৎফর রহমান।
ইংরেজ বৈমানিকের ইচ্ছা কেতাদুরস্ত সাহেবি পোশাক রেখে বাঙালি সৈনিকের ধুতি-পাঞ্জাবী পরে ছবি তোলার। ১৬ বছরের লুৎফর রহমানের জামা চেয়ে তার হাতেই নিজের ১২৭ বেবী ব্রাউনি ক্যামেরাটা তুলে দিলেন ঐ বৈমানিক।
সেসময় ইংরেজ সাহেবদের সরাসরি না বলার দুঃসাহস ছিল না কোন বাঙালির। লুৎফর রহমান নরম সুরে জানালেন- নিজের ধুতি-পাঞ্জাবী দিতে তার সমস্যা নেই, কিন্তু তিনি ক্যামেরা চালাতে জানেন না।
বৈমানিক তাকে শিখিয়ে দিলেন ক্যামেরা চালানোর কলাকৌশল। জীবনে প্রথম ক্যামেরা হাতে তুললেন লুৎফর রহমান। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এনালগ ক্যামেরায় তুলে ফেললেন সাদাকালো কিছু ছবিও! সেই থেকেই যাত্রা শুরু ভবিষ্যতের এক ‘ইতিহাসের সাক্ষীর’।
১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেয়া লুৎফর রহমানের পরিবার পরে চলে আসে রাজশাহীতে। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। যৌবনের ছবি তোলার শখ পরে পেশায় রূপ নেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তিনি ফটোগ্রাফিকে নিজের ধ্যান-জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্থানে ধারণ করে কিনে ফেলেন ১২০ আগফা বক্স ক্যামেরা। এসময় তিনি রাজশাহী শহরে স্টুডিও ফটোগ্রাফী ও প্রেস ফটো কাভারেজের কাজ করে প্রশংসিত হন।
রাজশাহী ও উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বড় কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা হলেই ডাক পড়তো লুৎফর রহমানের। ষাটের দশকের শুরুতেই তিনি রাজশাহীর বিশিষ্ট নাগরিকদের সান্নিধ্যে আসেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালিন দুর্লভ সব ছবির কারিগর ছিলেন এই প্রথিতযশা আলোকচিত্র শিল্পী।
৪৫ বছরের কর্মময় জীবনে প্রয়াত লুৎফর রহমান ১৯৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণা, ৭০’র নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অসংখ্য দুর্লভ ছবি তুলেছেন।
স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের গুরুত্বপুর্ণ অনুষ্ঠানিকতা ও ঘরোয়া মূহুর্তের বহু মূল্যবান ছবি তিনি তার ক্যামেরায় ধারণ করেছেন। কালের সাক্ষী এসব ছবি ইতিহাসের দৃশ্যপট হিসেবে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।
১৯৭২ সালের ১০ টাকার নোটে ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধুর ছবিটিও তারই তোলা। এজন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন।
পাকিস্তান আমলে তিনি রেডিও পাকিস্তান এর মুখপত্র ‘এলহান’ ম্যাগাজিনে কাজ করতেন। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বেতারের বেতার বাংলায় তার তোলা অনেক ছবি ছাপা হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম, মওলানা ভাষানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, আব্দুল আলীম, জিয়াউর রহমানসহ- বহু কিংবদন্তি বাঙালি লুৎফর রহমানের ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন।
ফলে মহাখালীতে তার প্রতিষ্ঠিত ‘প্রতিচ্ছবি’ ফটো স্টুডিওটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক আর্কাইভে রূপ নিয়েছে।
লুৎফর রহমান ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফটোগ্রাফি কম্পিটিশনে ১ম পুরস্কার পান। আলোকচিত্রে অবদান রাখায় বিভিন্ন সময়ে তিনি মর্যাদাপূর্ণ সনদ ও পদক লাভ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ভারত সরকারের কাছ থেকেও পেয়েছেন ২টি সার্টিফিকেট।
প্রখ্যাত এ ফটোগ্রাফার ২০০৬ সালের ১১ অক্টোবর অনন্তলোকে পাড়ি জমান। ব্যক্তি জীবনে তিনি এক ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। তার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুও একজন আলোকচিত্রী।
