আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক
মর্যাদাপূর্ণ নোবেল শান্তি পুরস্কার এ বছর কে পেতে যাচ্ছেন, তা জানতে আর মাত্র একদিন বাকি। আর এবারের পুরস্কার নিয়ে আগ্রহ বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিটি নিজেই বহুবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন অবস্থায় দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে ফিরে এসেছেন, যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রাণঘাতি সংঘর্ষ চলছিল।
নির্বাচনী লড়াইয়েই ট্রাম্প এসব যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছিলেন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নিজেকে ‘শান্তির দূত’ হিসেবে তুলে ধরতে ট্রাম্পকে বেশ আগ্রহী হতে দেখা যায়।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত থেকে শুরু করে গাজা ও ইউক্রেন যুদ্ধ- সবখানেই মধ্যস্ততা করতে বেশ তৎপর দেখা যায় ট্রাম্পকে। আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান, যাকে দেশে দেশে যুদ্ধ থামাতে ‘মরিয়া’ চেষ্টা চালাতে দেখা গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কি নোবেল পুরস্কারের জন্য যথেষ্ঠ? সত্যিই কি ট্রাম্পের হাতে ওঠতে যাচ্ছে শান্তির প্রতীক?
ট্রাম্প যে কারণে নোবেল পুরস্কারের দাবি করছেন
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সব সময় যে কোন পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী দেখা যায়। দুরত্ব কমিয়ে বিভিন্ন পক্ষকে ‘চুক্তিতে’ আনতে মধ্যস্ততাকারী হতে বরাবরই তিনি পছন্দ করেন।
নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতেও ট্রাম্পের আগ্রহ বহু পুরনো।
২০১৮ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে তার বৈঠক বিশ্বে আলোড়ন তোলে। পশ্চিমারা যখন উনকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়ায় ছিল, ট্রাম্প তখন তাকে আলোচনার টেবিলে বসান।
দুই কোরিয়ার মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা চালানোয় সে বছর কয়েকজন নরওয়েজিয়ান সংসদ সদস্য নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম প্রস্তাব করেন।
এরপর ২০২০ সালে ট্রাম্প ইসরায়েলের সঙ্গে আরবদের দুরত্ব কমাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেন। তাতে আরব দেশগুলো পুরনো বিভেদ কাটিয়ে তেল আবিবের সঙ্গে কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
সে বছরও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার প্রস্তাব যায় কমিটির কাছে।
অর্থাৎ, এ বছরের আগেও ২০১৮ ও ২০২০ সালে ২ বার ডোনাল্ড ট্রাম্প নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পান।
এবার ক্ষমতায় এসেই ট্রাম্প ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ থামানোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করেন।
ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও আলোচনায় বসেন তিনি।
এরইমধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তান। কার্যত ট্রাম্পের ‘ধমকেই’ থামে পারমানবিক শক্তিধর দুই দেশের লড়াই।
এসব প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প বলে আসছেন, নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য তিনি ‘যথেষ্ঠ’ কাজ করে ফেলেছেন।
একইসঙ্গে ইসরায়েল ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শান্তি পুরস্কারের জন্য ট্রাম্পকে মনোনীত করে নোবেল কমিটির কাছে প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে।
গাজা ও ইউক্রেনে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনা কতটা সফল?
গাজায় যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প ২০ দফা পরিকল্পনা দিয়েছেন। তার জোর প্রচেষ্টায় মিশরে হামাস ও ইসরায়েল শান্তি আলোচনায় বসেছে।
ইতোমধ্যে ট্রাম্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই পক্ষই প্রথম ধাপের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে।
এর ফলে গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠানো, ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করা ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের ফেরত নেয়ার পথ খুলেছে।
এতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কূটনৈতিকভাবে এতটাই সফল হয়েছেন যে- তার প্রস্তাবিত চুক্তিতে সম্মত হয়ে দুই পক্ষই নিজেদের বিজয়ী হিসেবে দাবি করছে।
তবে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হলেও গাজায় ইসরায়েলের হামলা অব্যাহত থাকায়, এ চুক্তি কতটা কার্যকর হবে- তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশ্লেষকদের মধ্যে।
অন্যদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাতে রুশদের সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের কয়েক দফা আলোচনায় বসিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নিজে বৈঠক করেছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে।
তবে এসব আলোচনায় মস্কোকে যুদ্ধ থামাতে রাজি করানো যায় নি। ফলে মস্কো ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে দেখা যায় ট্রাম্প প্রশাসনকে।
অর্থাৎ, ইউক্রেনে যুদ্ধ না থামলেও ট্রাম্পের আন্তরিকতা ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
নতুন সংঘাতের ‘দুয়ার খোলা’
দেশে দেশে যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্প আগ্রহী হলেও বিপরীতে বিভিন্ন সংঘাতে তার নাম চলে আসছে।
ইরানে ইসরায়েলের হামলার পিছনে ট্রাম্পকেই দায়ী করে আসছে তেহরান।
ট্রাম্পের নির্দেশেই ভেনিজুয়েলার নৌযানে প্রাণঘাতি হামলা চালাচ্ছে মার্কিন বাহিনী।
একইসঙ্গে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রে ভিন্নমত দমাতে বিভিন্ন বাহিনীকে ব্যাপক বলপ্রয়োগে ব্যবহার করতেও দেখা যাচ্ছে।
নোবেল কমিটি যেভাবে শান্তি পুরস্কারের জন্য বিবেচনা করে
নোবেল শান্তি পুরস্কার সাধারণত তাদের দেয়া হয়, যারা দীর্ঘ সময় ধরে আন্তর্জাতিক শান্তি, মানবাধিকার ও সমঝোতায় ভূমিকা রাখেন।
ট্রাম্প এসব ক্ষেত্রে উদ্যােগী হলেও তার সব প্রচেষ্টা বাস্তবায়ন হয়নি, বরং আলোচনার পর্যায়েই রয়ে গেছে।
এছাড়া আগের মেয়াদে তিনি ইরানের পরমাণু চুক্তি, প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাগ্রিমেন্টের মত বহু আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন।
ফলে বিশ্লেষকরা বলছেন, নোবেল কমিটির সামনে ট্রাম্পের জন্য সম্ভাবনার পাশাপাশি অনেক প্রশ্নও থাকবে।
সমালোচনা ও বিতর্ক
ট্রাম্প সমর্থকরা তাকে ‘শান্তির দূত’ বললেও বিরোধীদের কাছে তিনি ‘বিভাজন ও সংঘাত’ এর প্রতীক।
মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু হ্যামিলটনের ভাষ্য, নোবেল শান্তি পুরস্কার বাস্তব ফলাফলের জন্য দেওয়া হয়, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে যা এখনো প্রমাণিত নয়।
অন্যদিকে রিপাবলিকান শিবিরের কেউ কেউ বলছেন, বারাক ওবামার তুলনায় ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি পুরস্কারের জন্য আরও বেশি যোগ্য।
২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই বারাক ওবামার নোবেল পুরস্কার পাওয়া নিয়েও সেসময় বেশ বিতর্ক হয়েছিল।
ট্রাম্পের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা?
বিশ্ব রাজনীতিতে ট্রাম্পের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। তার কূটনৈতিক ধরন অনেক সময় আক্রমণাত্মক হলেও দরকষাকষিতে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
তবে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য শুধু কূটনৈতিক তৎপরতা যথেষ্ঠ না। প্রয়োজন দীর্ঘস্থায়ী শান্তি উদ্যোগ ও তার প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন।
কিন্তু নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার একদিন আগেও দেখা যাচ্ছে- ইউক্রেনে রুশ হামলা চলছেই এবং গাজায় মানবিক সংকটও কমেনি।
অন্যদিকে মার্কিন বাহিনীর হাতে ভিনদেশী নাগরিক হত্যাও বন্ধ হয়নি।
তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এ মুহূর্তে ট্রাম্পের নোবেল জয়ের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবে সংঘাতপ্রবণ পৃথিবীতে ট্রাম্প শান্তির পক্ষে যে আশা জাগানিয়া দূতায়ালি করছেন- নোবেল কমিটি তা বিবেচনা করলে অবাক হওয়ারও কিছু থাকবে না।
তারা বলছেন, ট্রাম্প যদি সত্যিই আন্তরিক থাকেন, তাহলে শান্তি সমাধান কঠিন কিছু হবে না। এর জন্য ভবিষ্যতেও ট্রাম্পের সামনে নোবেল পুরস্কারের দরজা খোলা থাকবে।
