সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড়ে দিনে ১০০ টি করে চুল পড়তে পারে। নিয়মিত চুল পড়া স্বাভাবিক হলেও অতিরিক্ত বা হঠাৎ চুল পড়া স্বাস্থ্য ও জীবনধারার কোন সমস্যার ইঙ্গিত দিতে পারে।
সঠিক কারণ বোঝা এবং সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া গেলে চুল পড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
চুর পড়ার কারণ
চুল পড়ার পেছনে নানা ধরনের কারণ থাকতে পারে। প্রধান কারণগুলো হলো-
১. জেনেটিক কারণ: পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে হেয়ার লসের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল পারিবারিক প্রবণতা। অর্থাৎ বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের চুল পড়ার সমস্যা থাকলে তা আপনার ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে।
এই ধরনের চুল পড়া সাধারণত মাথার সামনের বা উপরের অংশে বেশি দেখা যায়।
২. হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থা, প্রসব, মেনোপজ, থাইরয়েড বা হরমোনের অস্বাভাবিকতা চুল পড়ার অন্যতম কারণ।
৩. পুষ্টিহীনতা: প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন D, B-কমপ্লেক্স এবং জিঙ্কের অভাব চুল দুর্বল করে এবং দ্রুত পড়তে পারে।
৪. মানসিক চাপ ও জীবনধারা: স্ট্রেস, ঘুমের অভাব, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য এবং অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম (বিশেষ করে মোবাইল দেখা) চুলের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। চুল পড়া বাড়িয়ে দিতে পারে।
৫. চুলের অতিরিক্ত যত্ন বা রাসায়নিক ব্যবহার: বারবার কালার করা, পার্মিং, হিট স্টাইলিং বা কড়া শ্যাম্পু চুল দুর্বল করে ফেলে। যা একসময় চুল পড়ার কারন হয়ে দাঁড়ায়।
৬. চিকিৎসা ও রোগ: কিছু ওষুধ (যেমন ক্যান্সার থেরাপি, ব্লাড প্রেসার ওষুধ) এবং স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন অটোইমিউন ডিজিজ, ডায়াবেটিস) চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
চুল পড়ার লক্ষণ
চুল পড়া বিভিন্নভাবে প্রকাশ পেতে পারে:
হঠাৎ বা ক্রমাগত চুল পড়া: প্রতিদিন অনেক চুল পড়া স্বাভাবিকের বাইরে হলে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
মাথার খালি অংশ দেখা: বিশেষ করে মাথার সামনের অংশ বা ক্রাউন এলাকায় খালি অংশ দেখা যাওয়া চুল পড়ার বড় লক্ষণ।
চুল দুর্বল ও ভেঙে যাওয়া: চুল পড়ার সঙ্গে চুলের ভঙ্গুরতা বাড়ে। চুলের মাথা ভাঙতে থাকলে, চুল সতেজতা হারালে সতর্ক হোন। এগুলো চুল পড়া বাড়ার বার্তাও হতে পারে।
অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লালচে বা রুক্ষ ত্বক: কখনও কখনও চুল পড়ার সঙ্গে ত্বকের সমস্যা জড়িত থাকে। তাই মাথার ত্বক শুকিয়ে গেলে, খুসকি হলে, ত্বকে চুলকানির সমস্যা থাকলে তার সমাধান করুন।
চুল পড়ার প্রভাব
চুল পড়া কেবল শারীরিক নয়, মানসিক প্রভাবও ফেলে। এর ফলে অনেকের আত্মবিশ্বাস কমে যায়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বাড়ে। সামাজিক জীবনেও এর প্রভাব পড়ে। কারণ, বয়সের চেয়ে বৃদ্ধ দেখানোর ধাক্কা সবাই সামলাতে পারে না।
চুল পড়া কমাতে করণীয়
চুল পড়া কমাতে চুলের যত্ন নিতে হবে। জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনাসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ: প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার (ডিম, মাংস, ডাল, মাছ, বাদাম, মুরগি) গ্রহণ করতে হবে। আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন বি১২, ক্যালসিয়াম এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
ভিটামিন এ জাতীয় খাবার যেমন- মিষ্টি আলু, কাঁচা শাকসবজি বেশি করে খান। কারণ ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ ফল এবং শাকসবজি চুলের বৃদ্ধি বাড়ায়।
২. চুলের স্বাস্থ্যকর যত্ন: হালকা শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। অতিরিক্ত রাসায়নিক বা হিট স্টাইলিং এড়ানোর চেষ্টা করুন। নিয়মিত কন্ডিশনার ব্যবহার করুন।
৩. মানসিক চাপ কমানো: পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করুন। যোগ ব্যায়াম, মেডিটেশন বা হালকা ব্যায়াম করুন। স্ট্রেস হ্রাসে নিজের পছন্দের বা স্বাস্থ্যকর কাজে অংশ নিন।
৪. প্রয়োজনে চিকিৎসা: চুল পড়া ক্রমাগত বাড়লে বা হঠাৎ চুল পড়া শুরু হলে ডার্মাটোলজিস্ট বা হেয়ার স্পেশালিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
হরমোন, থাইরয়েড বা পুষ্টি সমস্যা থাকলে পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিন। কারণ চুল পড়া একটি সাধারণ সমস্যা হলেও এটি উপেক্ষা করলে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে।
নিয়মিত যত্ন, পুষ্টিকর খাদ্য এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে সময়মতো চিকিৎসা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।
চুলের যত্নের নিয়ম
চুল পড়া প্রতিরোধে সঠিকভাবে চুলের যত্ন নিতে হবে। নীচে চুলের যত্নের সাধারণ নিয়মগুলো তুলে ধরা হলো।
চুল আঁটসাট করে বেঁধে রাখা যাবে না। চুলকে সূর্যালোক, তাপ ও স্টাইলিং টুল থেকে রক্ষা করতে হবে।
সপ্তাহে ২–৩ বার হালকা শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। হিট স্টাইলিং ও কেমিক্যাল কম ব্যবহার করুন। নিয়মিত হেয়ার মাস্ক বা নার্সিং অয়েল ব্যবহার করুন।
মানসিক চাপ কমানো, যোগব্যায়াম, মেডিটেশন বা হালকা ব্যায়াম চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
হঠাৎ অতিরিক্ত চুল পড়লে বা স্ক্যাল্পে ফোলা, খুসকি দেখা দিলে ডার্মাটোলজিস্টের পরামর্শ নিন। হরমোন এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা চিহ্নিত করতে নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করানো উচিত।
চুল পড়ার ঘরোয়া প্রতিকার
চুল পড়া রোধের উপায় নীচে তুলে ধরা হলো।
নার্সিং অয়েল ম্যাসাজ: নারকেল, আয়ুর্বেদিক হেয়ার অয়েল বা আর্গান অয়েল ব্যবহার করে হালকা ম্যাসাজ করুন।
হারবাল হেয়ার প্যাক: আ্যলোভেরা, অমলা বা হেনা চুল শক্ত করে ও বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
প্রাকৃতিক শ্যাম্পু: কেমিক্যাল মুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করলে চুল কম পড়ে।
চুল পড়া কোনো অস্বাভাবিক সমস্যা নয়, তবে এটি যত্নের অভাবে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, মানসিক শান্তি এবং নিয়মিত চুলের যত্ন চুলকে সুস্থ রাখে। সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংক্ষেপে চুল পড়া কমানোর পরামর্শ
প্রোটিন ও ভিটামিনযুক্ত খাবার খান। অতিরিক্ত হিট ও কেমিক্যাল ব্যবহার পরিহার করুন। চাপ কমাতে ব্যায়াম বা মেডিটেশন করুন। সপ্তাহে ২–৩ বার হালকা শ্যাম্পু ব্যবহার করুন। নিয়মিত ডাক্তারি চেকআপ করুন।

1 thought on “চুল পড়ার কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধে করণীয়”
Comments are closed.