কৃষি: সকল সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল ভিত্তি

কৃষিবিদ ইমাম মেহেদী হাসান

কৃষি হলো মানব সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশের ভিত্তিপ্রস্তর। এটি মানব বসতির সূচনা থেকে শুরু করে আধুনিক সমাজের বেঁচে থাকা, অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি কেবল জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম নয় বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ভিত্তি।

কৃষির সূচনা:
প্রায় ১০. হাজার বছর আগে নবোপলীয় বিপ্লবের সময় কৃষির আবির্ভাবের মাধ্যমে মানব ইতিহাস এক রূপান্তর শুরু হয়। এর আগে আদিম মানুষ সবকিছুর জন্যই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল থাকত এবং যাযাবর শিকারী ও খাদ্য সংগ্রাহক হিসেবেই জীবনযাপন করত। এরপর যখন ফসল চাষ এবং পশুপালনের দিকে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে তারপর থেকেই স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপনের বা বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি হয়, যা সভ্যতার পথ আরো প্রশস্ত করে।

এই নতুন আবাসন মানুষকে কেবল সম্বলিত বা সমন্বিতভাবে বেঁচে থাকার জন্য আশান্বিত বা তৈরী করেননি বরং এর বাইরেও অন্যান্য নানান কার্যকলাপের উপর মনোনিবেশ করতে বা কার্যক্রম শুরু করতে আগ্রহী করে তুলে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সমাজব্যবস্থার আবির্ভাব শুরু হয়, যা ক্রমান্বয়ে শিল্প, ভাষা, ধর্ম এবং শাসনব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। কিন্তু মজার ব্যপার হলো এই বিষয়গুলোই কৃষিকে সাংস্কৃতির অগ্রগতির প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করে।

কৃষি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা:
সোজা কথা কৃষি কেবল প্রানীসমুহকে খাদ্য সরবরাহ করেনা, বরং ব্যবসা-বাণিজ্যকেও উৎসাহিত করেছে। যেমন, উৎপাদিত উদ্বৃত্ত ফসল পণ্যে পরিণত হয়েছে, যার ফলে বাজার প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিবর্তন ঘটেছে। এরফলে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় পণ্য বিনিময় থেকে শুরু করে আধুনিক কৃষি সবসময়ই বিশ্ব অর্থনীতির মেরুদণ্ড।

আমরা জানি, কৃষি আজ অনেক উন্নয়নশীল দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাথমিক জীবিকা, যা জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে বাংলাদেশে কৃষিতে জিডিপির অবদান প্রায় ১৪% এবং শ্রমশক্তির ৪০% এরও বেশি। যারদ্বারা প্রমানিত হয় সামাজিক কল্যাণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য কৃষি খাতের ভূমিকা অন্বসীকার্য।

সাংস্কৃতিক তাৎপর্য:
কৃষি বাস্তবিকই বিশ্বব্যাপী সংস্কৃতি, উৎসব এবং ঐতিহ্যকে ধারন ও বাহন করে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থ্যাঙ্কসগিভিং বা বাংলাদেশে নবান্নের মতো ফসল উৎসব কৃষির প্রাচুর্য এবং কৃষি সম্প্রদায়ের ঐক্য ও শক্তি প্রকাশ করে। কৃষি সংস্কৃতির জন্যই আজ শিল্প ও সাহিত্যে, মানুষ এবং জমির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরী হয়েছে।

কৃষি এছাড়াও খাদ্যাভ্যাস, রান্নার ঐতিহ্য এবং এমনকি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকেও নানান রুপদানে প্রকাশ করেছে। একসময়ের বন্য ফসল যেমন, গম, ধান এবং ভুট্টার মতো ফসলের চাষউপযোগীতা খাদ্যাভ্যাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। তাছাড়াও, পবিত্র কুরআনসহ অন্যান্য পবিত্র গ্রন্থগুলিতে একাধিকবার কৃষিকাজ এবং জমির রক্ষণাবেক্ষণের উপর বিশেষ তাৎপর্য বর্নিত হয়েছে ।

আধুনিক কৃষি: চ্যালেঞ্জ এবং উদ্ভাবন:
সভ্যতা যেমন এগিয়েছে, কৃষিও তেমনি এগিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর সবুজ বিপ্লবের ফলে কৃষিতে উচ্চ-ফলনশীল ফসলের জাত, রাসায়নিক সার এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছে, যার ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, এতেকরে আধুনিক কৃষি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আছে।

যেমন, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমির অবক্ষয়, পানির ঘাটতি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি খাদ্য ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আমরা জানি, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০ বিলিয়নে পৌঁছাতে পারে, তাতেকরে এই বর্তমান অপ্রতুল সম্পদের উপর খাদ্য উৎপাদনের চাপ আরও বেড়ে যাবে। তবে এখানে, আধুনিক জাত ও প্রযুক্তি এবং কৃষির যান্ত্রিকতা একটা গুরুত্বপুর্ন সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারে।

তাছাড়াও আমরা জানি, ডেটা বিশ্লেষণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) দ্বারা চালিত কৃষি ব্যবস্থা, কৃষিতে ব্যপক বিপ্লব ঘটাচ্ছে। স্মার্ট সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে সহজেই মাটির স্বাস্থ্য, আবহাওয়া পরিস্থিতি এবং ফসলের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে, যা কৃষকদের সিদ্ধান্ত নিতে এবং সম্পদের ব্যবহারকে সর্বোত্তম করতে সহায়তা করে। এই উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলি ও এর ব্যবহার কেবল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে না বরং পরিবেশগত প্রভাবও হ্রাস করে, এতেকরে টেকসই কৃষির একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।

স্থায়ীত্বের চালিকাশক্তিও কৃষি:
কৃষির ভূমিকা খাদ্য উৎপাদনের বাইরেও বিস্তত; যেনে অবাক হবেন যে, এটি বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনেরও কেন্দ্রবিন্দু। কৃষি বনায়ন, ফসল রোটেশন এবং জৈব চাষের মতো টেকসই কৃষি প্রযুক্তি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, কার্বন গ্রহন করে এবং বাস্তুতন্ত্র রক্ষা করে। উপরন্তু, জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি (CSA) খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু অভিযোজনের মতন সমস্যাগুলো নিয়ে যথেষ্ঠ পরিমান কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়াও, জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি (CSA) বাংলাদেশের মতো উপকূলীয় অঞ্চলের দেশগুলির জন্য কৃষির স্থায়ী সমাধানে আবাগ করার মতন ভুমিকা রাখছে। আশ্চর্যবিষয় হলো কৃষির ট্রাডিশনাল জ্ঞানকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে একীভূত করে ব্যবহারের ফলে সামাজিক এবং পরিবেশগত স্থায়ীশীলতার জন্য ঔষধের মতন কাজ করছে।

আগামীর সম্ভাবনা:
অবশ্যই কৃষির সংস্কৃতি ও সভ্যতার উপর গভীর প্রভাব আছে তবে চ্যালেঞ্জও আছে। ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য এই খাতের শক্তিশালী নীতিমালা, গবেষণায় বিনিয়োগ এবং বিশ্বব্যাপী সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি, বেসরকারি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়গুলিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করতে হবে। এবং ন্যায়সঙ্গত সম্পদ বন্টন নিশ্চিতসহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব প্রশমিত করতে একসাথে কাজ করতে হবে।

কৃষির এ যাত্রা, মানবজাতির অগ্রগতির প্রতিফলন এবং জীবিকা নির্বাহ থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্তমানে আমরা যখন একটি প্রযুক্তিগত বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি, সেই সময় কৃষিতে টেকসই ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে তাকে একটি সমৃদ্ধ সভ্যতার ভিত্তি হিসাবেই প্রকাশ করবে বলেই আশারাখি।

আসলেই কৃষি, সমস্ত সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল, এটি কেবল আমাদের শরীরের অগ্রগতিকেই নয় বরং মানব অগ্রগতিকেও নিয়ন্ত্রন করে থাকে। কৃষির রক্ষক হিসেবে আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হল এমন একটি ভবিষ্যত গড়ে তোলা যেখানে, প্রকৃতি এবং সমাজের সাথে কৃষিও সমানভাবে সমৃদ্ধ হবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়ন কর্মী