নিয়মতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ শিক্ষার্থীদের অধিকার

মো. কামরুল হাসান

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবি ছিল লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাসগুলোতে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ চালু করা। কিন্তু দৃশ্যপট অভীন্ন, ছাত্রসংসদ চালুতে প্রাকে-প্রাকারে, প্রত্যক্ষে-পরোক্ষে, দৃশ্যত-অদৃশ্যত নানা শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জাতীয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এর ফলে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে, ব্যক্তিত্বের উৎকর্ষ সাধিত হয়, জাতীয় পর্যায়ে নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠার প্রবল সম্ভাবনা থাকে, শিক্ষার্থীদের মাঝে রাজনীতি সচেতনতা ও গণতান্ত্রিক চর্চার উপযুক্ত সুযোগ তৈরী হয়, নিরাপদ নিরুপদ্রুব ক্যাম্পাস গঠনে, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে ছাত্র সংসদ।

সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা বহুল অংশগ্রহণে উৎসাহ পায়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক ও ন্যায্য দাবি আদায়ে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান, দেশে স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদী শাসন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে তার বুহ্যে কাঁপন ধরিয়ে দিতেও শক্তিশালী ও অপরিহার্য ভূমিকা রাখে ছাত্রসংসদ।

ছাত্রসংসদ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীজনদের মাঝে যোগসংযোগ তৈরী করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত কন্ঠ হয়ে কাজ করে, এটি শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থ, সম্মান ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি যুগান্তকারী প্লাটফর্ম।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ভিত্তি বিরচিত হয়ছে ছাত্রসমাজের ত্যাগ ও সংগ্রামের রক্ত-গল্প দিয়ে। দেশের দূর্যোগ, বিপর্যয়, রাজনৈতিক সংকটে ছাত্রসমাজই অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল যুগে যুগে। কার্যত, বড় কোন পটপরিবর্তনের গোড়াপত্তন ঘটেছে ছাত্রসমাজের হাত ধরে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান যার আরও একটি উদাহরণ।

দেশের স্বাধীকার আন্দোলন, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, এবং সবশেষ চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মত বড় আন্দোলন সংগ্রামেও ছাত্রসংসদের নেতারা অপরিমেয় অবদান রেখেছেন।

দেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩ টি। পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ঢাবি, চবি, জাবি ও রাবি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অগণিত কলেজ আছে, যেগুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত সেসব ক্যাম্পাস। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বহুমুখী সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। অগত্যাই শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তা, অভাব ও শঙ্কার মধ্যে নিমজ্জিত থাকতে হয় প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন যার ম্যান্ডেট সকল সাধারণ শিক্ষার্থী, একটি নির্মোহ, দূরদর্শী ও তারুণ্যনির্ভর গতিশীল নেতৃত্বগুণের উৎস ছাত্রসংসদ।

ঢাবিতে উৎসুক মুখর পরিবেশে এবার ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে, ইতোমধ্যে চবি, রাবি ও জাবিতেও জমে উঠেছে নির্বাচনের আবহ। কিন্তু দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীল পরিবেশ অনুপস্থিত। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় নয়। ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের ওপর স্থানীয়দের উপর্যুপরি সহিংস সন্ত্রাসি হামলা, এরপর রাবি, বাকৃবি, বেরোবিতে বহিরাগতদের হামলা ন্যাক্কারজনক উদাহরণ! এমন সময় এসব অনভিপ্রেত পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে যখন ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনেক প্রাসঙ্গিক!

এদিকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনও হচ্ছে। সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় অনশন করে শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়েও জাকসুর পালে বইছে হাওয়া। আন্দোলন সংগ্রামে জর্জরিত প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২০ বছর ধরেই ‘আমরা জকসু চাই’ শিরোনামে আন্দোলন করে আসছে। সম্প্রতি সম্পূরক বৃত্তি কার্যকর ও জকসু নির্বাচন এ দুই দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা ও ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠন আন্দোলন করছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দিতে অনিহা ও সদিচ্ছার অভাব দেখা যায় প্রায়ই। এর পেছনে প্রোথিত আছে বহুমুখী রাজনৈতিক ও নানা গোষ্ঠীর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণ।

প্রথমত, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা দলের ছাত্রসংগঠনের প্যানেল বিজয়ী না হওয়ার শঙ্কা।

দ্বিতীয়ত, দলীয় লেজুড়বৃত্তি কার্যক্রমের গতি বাধাগ্রস্ত হবে।

তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস পাবে।

চতুর্থত, ক্যাম্পাসে ছাত্রসংগঠনের আধিপত্যবাদ বিস্তারের মনোবাঞ্ছা ব্যাহত হবে।

একটি সুষ্ঠু সুন্দর নিরাপদ শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করণে এবং শিক্ষার্থী শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থ সমুন্নত রাখতে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ চালু করতে হবে, এটি শিক্ষার্থীদের প্রাধিকার।

লেখক

মো. কামরুল হাসান, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: kamruljnu02bd@gmail.com