সুন্নি ও শিয়ারা ভিন্নভাবে আশুরা পালন করে কেন?

নাড্ডা ওসমান

ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে আশুরা মুসলমানদের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ দিন।

ইসলামে আশুরা এমন একটি স্মরণীয় দিন, যা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

ইসলামিক ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখের এই দিনটি সুন্নি ও শিয়া মুসলিমরা নিজস্ব রীতিতে পালন করে।

আশুরা কি?

“আশুরা” শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “১০” থেকে। “মহররম” শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ “হারাম” থেকে, যার অর্থ নিষিদ্ধ।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুসারে, মহররম মাস হল ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে পবিত্র মাসগুলির মধ্যে একটি, যে সময়ে যুদ্ধ নিষিদ্ধ।

এই মাসের ১০ তারিখই আশুরা হিসেবে ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

ইসলামে আশুরা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

আশুরার দিনে মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাদের পূর্ববর্তী বছরের পাপ ক্ষমা করে দিবেন।

কুরআন অনুসারে, আল্লাহ মূসা (আ.) কে তার লাঠি দিয়ে লোহিত সাগরে আঘাত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যার ফলে পানি দুই ভাগ হয়ে যায়।

এরপর তিনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা হিসেবে আশুরার দিনে রোজা রাখা শুরু করেন।

মুহাম্মদ (সা.) অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের থেকে মুসলমানদের আলাদা করার জন্য ৯ম মহররম এবং ১০ম মহররম উভয় দিনেই রোজা রাখতে মুসলমানদের উৎসাহিত করেন।

যদিও এগুলো ঐচ্ছিক রোজা, অনেক মুসলমান তা পালন করেন।

মূসা (আ.) এর ঘটনার বহু বছর পর আশুরার দিনেই কারবালার মর্মান্তক ঘটনা ঘটে।

ইমাম হুসাইন (রা.) হত্যার ঘটনা ইসলামে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, পরবর্তীকালে তা ব্যাপক রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছিল।

সুন্নি এবং শিয়ারা আলাদাভাবে আশুরা পালন করে কেন?

সুন্নিরা মূলত মূসা (আ.) এর ঘটনা স্মরণ করে কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুসারে দিনটি পালন করে।

আর শিয়ারা দিনটি পালন করে ইমাম হুসাইন (রা.) এর মৃত্যুবার্ষিকী হিসেবে, যা তাদের ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

অর্থাৎ- একপক্ষ দিনটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য পালন করে, আরেকপক্ষ পালন করে শোক প্রকাশ করতে।

এই ভিন্ন প্রেক্ষাপটই মুসলমানদের দুটি ধারার আলাদাভাবে আশুরা পালনের পেছনে কাছ করছে।

ইরানের মত শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আশুরা ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়।

পাকিস্তানসহ কিছু দেশে আশুরার কর্মসূচি নিয়ে শিয়া ও সুন্নিদের সহিংস দ্বন্ধে জড়ানোর ঘটনাও ঘটে।

সুন্নিরা যেভাবে আশুরা পালন করে

সুন্নি মুসলমানদের কাছে আশুরাকে সেই দিন হিসেবে দেখা হয়, যেদিন মূসা (আ.) লোহিত সাগরকে বিভক্ত করে ইস্রায়েলীয়দের মিশর থেকে নিরাপদে বের করে আনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

সুন্নিরা দিনটিতে রোজা রাখেন, বিশেষ দোয়া ও ধর্মীয় আলোচনা করেন।

সুন্নিরাও ইমাম হুসাইনকে শ্রদ্ধা করে, ইয়াজিদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা রাখে।

কিছু সুন্নি হুসাইনের শোক অনুষ্ঠানেও অংশ নেয়, বিশেষ করে সুফি ঐতিহ্যের অনুসারীরা। যদিও শিয়াদের তুলনায় এসব অনুষ্ঠানে খুবই কম গুরুত্ব পায়।

শিয়ারা যেভাবে আশুরা পালন করে

শিয়া মুসলমানদের কাছে আশুরা একটি গৌরবময় ও শোকের দিন, যা ৬৮০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে কারবালার যুদ্ধে রাসূল (সা.) এর নাতি ইমাম হুসাইনকে হত্যার বার্ষিকীকে স্মরণ করে।

দিনটিতে শিয়ারা কারবালার বেদনাদায়ক ঘটনাকে নানাভাবে স্মরণ করে।

ইমাম হুসাইন রাসূল (সা.) এর মেয়ে ফাতিমা ও চাচাতো ভাই আলীর (রা.) ছেলে ছিলেন।

ঐতিহাসিকরা হযরত আলীর সঙ্গে মুয়াবিয়ার দ্বন্ধের ধারাক্রম হিসেবেই কারবালার পরিণতিকে দেখেন।

ইসলামী শাসনব্যবস্থার নেতৃত্বের দ্বন্ধে ইরাকের ফোরাত নদীর কাছে ইয়াজীদের অনুসারীদের দ্বারা ইমাম হুসাইন ও তার অনুসারীরা নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন।

শিয়াদের জন্য, হুসাইনের শাহাদাত ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার সাধনায় চূড়ান্ত মূল্য পরিশোধের প্রতীক।

দিনটিতে শিয়ারা তাজিয়া শোক মিছিল বের করে।

সেখানে কেউ কেউ ত্যাগ ও সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে নিজেকে ব্লেড, শিকলের মত বস্তু দিয়ে আঘাত করে থাকেন।

এ রীতিটি এখন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

ইরানের প্রয়াত নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনিসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় শিয়া ইসলামী আইনবিদও এই কাজের নিন্দা করেছেন।

তারা আধুনিক যুগে এটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে যুক্তি দিয়েছেন।

তবে শিয়া ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের একটি ছোট অংশ নিজের ক্ষতি না করে এ প্রথা চালুর রাখার উপর জোর দিয়েছেন।

অনেকে এর পরিবর্তে রক্তদানের মতো বিকল্প উপায়ে শোক প্রকাশ করতে পছন্দ করেন।

মহররমের সময় শিয়ারা প্রায়শই শোক এবং দুঃখের প্রতীক হিসেবে কালো পোশাক পরেন।

আশুরার দিন শিয়ারা কারবালায় হুসাইনের মাজারে এবং বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শোক পালন করে।

এ দিন শিয়া ধর্মপ্রচারকরা খুতবা দেন এবং কারবালার যুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনা করেন।

কেউ কেউ হুসাইনের জীবন সম্পর্কিত কবিতাও আবৃত্তি করেন, তাঁর গুণাবলী তুলে ধরেন।

ইরাক এবং ইরানের অনেক জায়গায় হাজার হাজার মানুষ নাটক, মিছিলে জড়ো হন।

এসব অনুষ্ঠানে কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে শোক প্রকাশ করা হয়।