ভারতে যেভাবে মুসলমানদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়

ভারতে মুসলমানদের অবস্থা

আরব উপদ্বীপ ও ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগলিক অবস্থান লক্ষ্য করলেই আপনি এই অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ কিভাবে হয়েছে তার একটি ধারনা পেয়ে যাবেন।

আরব উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তে স্থলপথে ইরান পেরুলেই ভারতীয় উপমহাদেশ। তবে এই দুই অঞ্চলের মূল সম্পর্ক গড়ে ওঠে সমুদ্র পথে, কারণ বাণিজ্য।

আরব সাগরের পশ্চিম প্রান্তে আরব দ্বীপের অবস্থান। সাগর পাড়ি দিয়ে পূর্ব উপকূলে আসলেই ভারত। এই সমুদ্র পথই প্রাচীন কাল থেকে ভারত ও আরবের ব্যবসায়ীদের মধ্যে গভীর যোগাযোগ তৈরি করে।

কারণ বিশ্বের ব্যস্ততম বাণিজ্য এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আরব ও ভারত অঞ্চল। সমুদ্র পথে এই দুই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যেতেন।

এই পথ ধরেই ভারতে ইসলামের প্রচার শুরু হয়। অর্থাৎ ভারতের পশ্চিম অঞ্চল প্রথম ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে।

যেভাবে ভারতে ইসলামের আগমন

৬১০ সালে হযরত মুহাম্মদ সা. নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। কুরআন নাজিল হওয়ার পর তিনি আরবে ইসলামের বার্তা প্রচার করতে থাকেন।

একটি নতুন ধর্মের আগমন বার্তা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই ভারতে এসে পৌঁছে যায়। আরব সাগরের পূর্ব প্রান্তের ভারতীয়রা ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে অল্প অল্প করে জানতে থাকেন যে, সাগরের পশ্চিম প্রান্তেই ইসলামের বিকাশ ঘটছে।

মক্কাবাসী ইসলামের খবর পাওয়ার এক যুগ পরই ভারতে মসজিদও তৈরি হয়ে যায়।

আরব সাগরের পূর্ব প্রান্তে মূলত গুজরাট থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় আরব ব্যবসায়ীরা বেশি আসতেন। ভারতের এই পশ্চিম অঞ্চলই প্রাথমিকভাবে ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারে।

আরবের যেসব ব্যবসায়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ রাসূল সা. এর জীবদ্দশায়ই ভারতে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। সাগর পাড়ি দিয়ে বাণিজ্য করার পাশাপাশি ভারতীয়দের তারা ইসলাম সম্পর্কে জানাতে থাকেন। আস্তে আস্তে মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হতে থাকে। 

কিছুদিনের মধ্যেই মালাবার এলাকার একজন রাজা চেরুমল পেরুমল আরব ব্যবসায়ীদের কাছে রাসূল সা. এর কথা শুনে তাদের সঙ্গে মদিনায় যান। সেখানেই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

স্থানীয় রাজার ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর মালাবার এলাকায় ইসলাম প্রচারের বিস্তৃতি বাড়তে থাকে। ৬২৩ সালের দিকে আরব ব্যবসায়ীরা ভারতে প্রথম মসজিদ তৈরি করেন। কাছাকাছি সময়ে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আরও কয়েকটি মসজিদ গড়ে ওঠে।

ভারতে ইসলাম কেন দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে?

ভারতের সাধারণ মানুষদের বড় অংশই ছিল দরিদ্র পীড়িত। তারা সমাজের নানা শ্রেণিভেদের কারণে নির্যাতিত হয়ে এসেছেন বহু বছর ধরে। বিশেষ করে রাজ পরিবারগুলোর নির্যাতন সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্দ করে তুলেছিল। সে সময়ের ভারতের ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথাগুলো সাধারণ মানুষকে মর্যাদাহীন করে তুলেছিল।

এই সাধারণ মানুষরা আরবের ব্যবসায়ীদের ভাল আচরণে মুগ্ধ ছিলেন। এই অনুকূল পরিস্থিতির মধ্যে সপ্তম শতাব্দীতেই আরবের ব্যবসায়ীদের একটি অংশ ভারতে থাকতে শুরু করেন। তাদের অনেকেই বিয়ে করে স্থানীয়দের সঙ্গে আত্নীয়তার সম্পর্ক গড়ে তুলেন।

যে সকল ভারতীয় বহুকাল ধরে বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছিলেন, তারা ইসলামের বার্তা পেয়ে জীবনের নতুন আশা দেখতে পান। ফলে বিশেষ করে নিম্নশ্রেণীর মানুষরা দ্রুত মুসলমান হতে থাকেন।

একই সময়ে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আরবের সুফি-সাধকরাও ভারতে আসতে থাকেন। তাদের উদার ব্যবহার ভারতীয়দের আরও বেশি মুগ্ধ করে, যা তাদেরকে ধর্ম পরিবর্তনে উৎসাহিত করে।

অষ্টম শতাব্দীর শুরু থেকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ভারতে ইসলামের প্রভাব দেখা যায়। মূলত বাইরের সামরিক শক্তি হিসেবেই সীমিত কিছু অভিযান চালাতে মুসলিম সমরনায়করা। এসব অভিযানের সঙ্গে ধর্ম প্রচারের কোন সম্পর্ক না থাকলেও এ অঞ্চলে মুসলমানদের প্রভাব বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজা দাহিরকে হারিয়ে ৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাশিমের সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে এর দ্বার খুলে।

পরবর্তীতে ইসলামী খেলাফতের সময় স্থল ও জলপথে ভারতে মুসলিম সেনাপতিরা বিচ্ছিন্নভাবে ছোট ছোট অভিযান চালায়। অষ্টম শতাব্দীতে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে হামলা চালিয়ে কিছু অঞ্চলও দখল করে নেন তারা।

মূলত প্রজাদের ওপর বৈষম্য, নির্যাতন এবং বিলাসিতার কারণে ভারতের রাজ পরিবারগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। রাজাদের জনবিচ্ছিন্নতা ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে সাহায্য করেছে। দশম শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদের মত যোদ্ধারা ধারাবাহিকভাবে ভারতে আক্রমণ করতে থাকেন, মূলত এ অঞ্চলের সম্পদ লুটই ছিল এসব অভিযানের লক্ষ্য।

১২০৪ সালে বখতিয়ার খিলজি বাংলা জয় করেন। এর আগেই মুহাম্মদ ঘুরি ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকা দখলে নেন। এভাবে ষোড়শ শতক পর্যন্ত ভারতে মুসলিম শাসকদের জয়যাত্রা চলতে থাকে। বিশেষ করে মোঘলরা ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলেই নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

বিভিন্ন যুদ্ধে মুসলমানদের জয়ের ফলে ভারতের আরও বেশি মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। মুসলমানরা ভারতের অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। কয়েকশ বছরে ধরে ভারতে মুসলিম শাসকরা রাজত্ব করেন।

ধীরে ধীরে এই শাসনব্যবস্থাও দুর্বল হতে থাকে। অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, বিলাসিতা মুসলিম শাসকদের জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ১৭০৭ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুসলিম শাসকরা রাজ্য হারাতে থাকেন। বিপরীতে মারাঠারা ভারতের বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠতে থাকে। কিন্তু ব্রিটিশরা আসার পর প্রায় ২০০ বছরের জন্য পরাধীনতা নেমে আসে ভারতবাসীর জন্য।

তবে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিমদের প্রভাব এই অঞ্চলে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। ভারত ভেঙে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ জন্ম নেয়।

এই দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ছাড়াও ভারতের নাগরিকদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যা মুসলমানদের। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান বিশ্বে এখন তৃতীয়। দেশটিতে মুসলমানদের সংখ্যা ২০ কোটির বেশি, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি।